ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] ঘুম ঘুম ঘ্ঘ্ঘ্ঘ্ঘ্ঘ্ঘ্ (প্রহর এক)

ক.

কম-পড়াশোনার কম-দেখা জীবনে আমি সত্যিই সত্ভাবেই জানি না- “এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি?” লাইনটা কার (এই লেখাটি লিখবার সময় জানতাম না; পরে কমেন্টের ঘরে সহ-ব্লগারদের থেকে জেনেছি এবং পরে কবিতাটা পড়েছিও- হ্যাঁ, এটা জীবনানন্দ দাশের)! এই ব্লগ-ময়দানে এসে একজন ব্লগারের সিগনেচার হিসেবে এই লাইনটি দেখে কতো সময় যে মাথায় কতো কী কাজ করেছে, আর কতো ছবি যে ভেসে উঠেছে মনে- সব মনে ক’রে বলতেও পারবো না এক আয়োজনে! হ্যাঁ, সেই ব্লগারের এখানকার নিক ‘খেকশিয়াল’ (তার সত্যি মানুষ-নামটি পরে জানা হয়েছে তার সাথে সাক্ষাতে, তবু সে নাম এখানে না আনলেও চলে। সত্যিই, সারাজীবনে তার আরো অনেক নাম জানা হ’লেও তার সাথে আমার প্রাইমারি অ্যাসোসিয়েশন যে শব্দটির থাকবে, সেটি ‘খেকশিয়াল’, আর ভিজ্যুয়াল অ্যাসোসিয়েশন হিসেবেও
তার সাথে সাথে চোখে ভাসবে, এখনও ভাসে সেই আধো আধো ছবিটিরই আদল, যা সেই সময়টাতে তার ছবি হিসেবে ছিল ব্লগে, যখন আমি পাড়া দিয়েছিলাম এ পাড়ায়।) আরো উল্লেখ্য, অনেকেরই সিগনেচারে দিনের আবহাওয়ার মতো ঘন-হালকা অনেক হারেই পরিবর্তন দেখেছি, নতুন নতুন সিগনেচারের সাথে ব্লগারের নাম বা নিক মিলিয়ে নিতে অভ্যস্তও হয়েছি, তবে খেকশিয়ালের স্বাক্ষর এখনও সেই ‘এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি?’ই আছে। না, আমি চাইওনি এই স্বাক্ষরের কোনো পরিবর্তন। আজ পর্যন্ত এখন পর্যন্ত যতোবারই খেকশিয়ালের যতো ব্লগে কিংবা অন্যদেরও যতো ব্লগের নিচে খেকশিয়ালের যতো কমেন্টের নিচে পিলার হিসেবে এ লাইনটি যতোবার দেখেছি, কিছু না কিছু একটা আরো জিনিস আমার চোখে বা মনে ভেসেছে, তা সে যতোই অসম্পূর্ণ আর আধো আধো ইমেজ হোক না কেন! হ্যাঁ, এই ‘এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি?’র মধ্যে একটা বাড়াবাড়ি জাদু তো ঠিক এই শব্দগুচ্ছটির জন্যই আছে, তবে তার মধ্যেও আদি আসোল ঘোরটা একেবারেই ‘ঘুম’এর মধ্যে। এই ‘ঘুম’কে আমার একবার মনে হয়েছে নিদ্রা, একবার বিরাম, একবার পরাজয়, একবার মৃত্যু, একবার ছুটি, একবার বিদায়, একবার নীরবতা, একবার অভিমান, একবার আলিঙ্গন, একবার সবুজ পুকুরের অন্ধকার ডুবসাঁতার, একবার হতাশার নিমজ্জন, একবার বিরহ, এমনকি একবার সঙ্গম, ... আর কী-ই বা না?!

খ.

খেকশিয়ালকে নিয়ে তো না-ই এই লেখাটা, ‘এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি’র ঘোরস্রষ্টাকে নিয়েও না - জ্বি জনাব, আমার শিরোনাম শতভাগ ফোকাসড আর ডিরেক্টই আছে - লেখাটা শ্রেফ ঘুম নিয়ে, কিংবা ঘুমের নানা রূপ-অরূপ ঘোর-বেঘোর নিয়ে। না, ঘুমের শারীর-বৈজ্ঞানিক কোনো ব্যবচ্ছেদ নয়, ঘুমের মনোবিজ্ঞানও নয়, এটা বড়জোর ঘুমের একটা ব্যক্তিমানসিক ঘোর!

গ.

গরিব ব্লগারের অর্বাচীনত্বে বরং দয়া দেখান, রাগ মোটেই দেখাবেন না! যে সহব্লগার এখন ঠোঁট উল্টে ভুরু কুচকে মন খিঁচে ভাবছেন- এই কথার জন্য আগে ওই এত বড় ভনিতা কেন!, তাকে বলি- প্রথম অনুচ্ছেদটা শুধু একটা নামেমাত্র ‘ভূমিকা’ না, ওই ব্যাপারটার সত্যি সত্যিই যথার্থই বড় ভূমিকা আছে বর্তমান লেখাটার সংঘটন আর সংগঠনের পিছনে।

ঘঘঘঘঘঘঘ.

ঘুম বা নিদ্রা শরীরের এমনই এক নিতান্ত-জৈবিক ক্রিয়া বা প্রক্রিয়া, যে এর সাথে আমাদের পরিচয়ের জন্য শ্রেণীকক্ষীয় কোনো আয়োজনের প্রয়োজন হয় না। ঠিক ক’রে ঘুমাতে পারার জন্য বই প’ড়েও শিখতে হয় না ঘুমের সঠিক প্রক্রিয়া। এমনকি তেমনও নয় যে একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছুলে অভিজ্ঞ পূর্বসূরি হিসেবে মা-নানী বা বাপ-দাদাকে খেয়াল ক’রে আগ বাড়িয়ে এসে উত্তরপ্রজন্মকে দিতে হয় ঘুম বিষয়ক কোনো শলা কিংবা দীক্ষা। বিনা টিকিটেরই এক আনন্দ-ভ্রমণ এটা, বিনা দীক্ষায় সিদ্ধি, বিনা কারচুপিতেই মুক্তি।

ঙ.

(অ)ঙক ক’ষে ঘুমানোর মতো বিদ্বান কিংবা নির্বোধ কোনোটাই আমি নই! সেই অংকের আবার ফল যদি নামে ন্যূনতম ঘুমের ব্যবস্থাপত্র, তবে তো আরোই আমি নেই ওই পক্ষের ধারেকাছে! একেবারে আদিতে তত্ত্বটি কার, জানা নেই বা মনে নেই- হ’তেও পারে যার নাম বলছি তাঁরই! অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ আবু সাঈদের কথায় শুনেছিলাম (ভার্সিটি-মাঠে আমার সবচেয়ে প্রিয় আর সফল বিদ্যাকৃষক ড. মিজানুর রহমান প্রথমে প'ড়ে শুনিয়েছিলেন তুলনামূলক আইনের (কম্পারেটিভ ল) ক্লাসে! যদ্দূর মনে পড়ে “নিষ্ফলা মাঠের কৃষক” থেকেই) - যে দিনে ছয় ঘণ্টা ঘুমায়, সেও জীবনের চার ভাগের এক ভাগ অপচয় করে। এই হিসেবটি সেখানে আগে-পরে আরো অনুপুঙ্খ টানাই ছিল, যার পুরোটা এখানে টেনে আনা মোটেই দরকার হবে না কথাটির মূলসুরটি বুঝাবার জন্য। আমার সেই শিক্ষকও আমার দেখা সেই কয়েকটা মানুষের একজন, যাদেরকে যতোই দেখেছি যতোই বুঝেছি, আমি বরং ততোই কম বুঝেছি আর বেশি ক’রে অবাক হয়েছি এটা ভেবে- এই যে আইন-ইতিহাস-রাজনীতি-শিল্পকলার এত এত বই তাঁর পড়া, এত মুভি এত শিল্পকর্ম দেখা, এত কাজও করতে থাকা এই এক জীবনের পুরোটা ঠেঁসে, ভদ্রলোক ঘুমান কতোক্ষণ বা আদৌ কখন! আমার কাছেই এই বিস্ময়টা বেশি, হয়তো এ কারণেই যে- হ্যাঁ, আমি একটু বেশিই ঘুমকাতুরে। আঁতেলেকচুয়ালি না একদমই, একেবারে নির্মল নির্জলা সত্য বলছি- এই তিরিশোর্ধ্ব জীবনে এত যে কম দেখা-শোনা-পড়া-জানা আমার, তার পিছনে অন্যতম বড় কারণ আমার ঘুমকাতুরে বিড়ালজীবন। একটু ফোম পেলেই ঘুম, আর ওম্ পেলে তো কথাই নেই!

চ.

চার্জ ছাড়া কোনো যন্ত্রই চলে না। মানবযন্ত্রও না। এরকম কোনো একটা ঝাড়াহাত অজুহাত আমার তো অন্তত লাগবেই। আমার তো মনে হয় (যেন আমার মনে হওয়ায় কতো কী এসে যায় এই ব্রহ্মাণ্ডের!)- ঘুম শরীরের চলার জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটা চার্জ! এই রিচার্জ ঠিকমতো না হ’লে পরের কাজ হবে কীভাবে!- এই চিন্তা থেকেই আমার বেশি ঘুমের জাস্টিফিকেশনের শুরু, কিন্তু ঘুমাতে ঘুমাতে যে পরের সেই কাজের বেলাটাই পুরো পার ক’রে ফেলি আমি, সেখানে অবশ্য সেই জাস্টিফিকেশনের শেষ মেলা দায়!

ছ.

ছাত্রজীবনের দিকে পিছু তাকাই একটু। কলেজ-লাইফে (কিংবা বলা ভালো আমার ইন্টারমিডিয়েট জেল-লাইফে) মোটামুটি নিয়ম ক’রেই সপ্তাহে অন্তত দুইরাত আমার কাটতো একেবারেই ঘুমহীন। সেটার কারণ ছিল পশ্চাদ্দেশে আগুন নিয়ে সাপ্তাহিক দু’টো কুইজের প্রস্তুতি। তখন বাজারে নতুন আসা এক প্যাকেট 'বঙ্গজ' বিস্কুটের সঙ্গে সারারাত জেগে সকালে রাজ্যের ঘুম চোখে ক’রে পরীক্ষার হল-এ ঢুকে লিখতে লিখতে প্রশ্ন দেখতে দেখতেই একটু পরপর চোখে সর্ষেফুলের চেয়েও গাঢ় হলুদ কোনো ফুল দেখতাম যেন! আর, সেই কুইজ কোনোমতে পার ক’রে গিয়ে যখন আবার শুরু করতে হ’তো দিনের ক্লাস, সারা সারা সারা দিইইইন, প্রতি ক্লাসের বেলের পর একবার ক’রে যে ভাব আসতো চোখে-দেহে-মনে, সেটার ভাষা পেয়েছি আরো বহুবছর পরে- “গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে, গাড়ি চলে না।” পরেও অনেক সময়ে অনেক রকম চাপে প’ড়ে অনেক রাত জাগতে হয়েছে বৈকি। এক-দুই রাত ঘুমের অনিয়মের বর্তমান তো কোনোমতে সহ্য ক’রে ফেলতে পারি দাঁত-চোখ খিঁচে, কিন্তু তার ভবিষ্যতের তৃতীয় দিন যে শরীর আর কোনো কিছুই শুনতে চায় না! পুরোপুরিই “ডায়নামা বিকল হইয়াছে, উপায়-বুদ্ধি মেলে না” মোডে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই পাই না তখন। আর আজকাল তো সেডেন্টারি কর্পোরেট লাইফে একটুও যা ঢুকেছি, তার ঠেলাতেই শরীর দিনকেদিন যেভাবে আয়েশী হয়ে উঠছে, মহাশয়গিরি তার রীতিমতো চুলোয় যেতে বসেছে! দলগতভাবে হ’লেও আমাকে পাত্তা দিয়ে বা দিতে আরেকটি তত্ত্বও অবশ্য এসেছে অল্পচেনা প্রতিবেশী বিজ্ঞানের ঘরে।- আমরা যারা ‘ক্রিয়েটিভ’ [ইশ্, নামের কী বাহারি ছিরি!] চাকরি-বাকরি করি, মানে এই অ্যাডভার্টাইজিং-ক্রিয়েটিভদের মতো আরো যাদের কিনা প্রফেশনালিই চিন্তা করাটাই মূল কাজ, সরাসরি মগজ বা মস্তিষ্কের খাটাখাটুনির জন্য সারাদিনে আমাদের শারীর-যান্ত্রিক শক্তিক্ষয় বা শ্রম যায় অনেক বেশি, তাই আমাদের মাথাও রাতে ঘুম চায় একটু বেশি বেশিই।

[দ্বিতীয় প্রহরে সমাপ্য। আগে একটু, না চা খেয়ে না, ঘুমিয়ে আসি।]

(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০০৯-০৪-২৭ ১৩:১৯)

কোন মন্তব্য নেই: