ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১১

[পূর্বপ্রকাশিত] কলজে-তে যেই কলেজেরই এক ছাপ নিয়ে দিই পথপাড়ি

"কোলকাতার মেয়েরা, বাংলাদেশের ছেলেদেরকে খুব পছন্দ করে! তুমি গেলে দেখবে-- ওরা কয়েকজন হেঁটে যাওয়ার সময়, এক সখীর গায়ে ঠেস দিয়ে অন্য সখী বলবে-- 'দ্যাখ্ দ্যাখ্, বাংলাদেশের ছেলে, বাঘের বাচ্চা একটা!' আর, যদি শোনে-- তুমি নটর ডেম কলেজের ছাত্র, তাহ'লে তো তোমার সামনে বেচ্যায়েন হয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়বে!"

না, কলেজের নামেই কোলকাতার কিংবা ঢাকার-খুলনার কোনো মেয়েকে চ্যায়নে বা বেচ্যায়নে কোনোভাবেই শোয়ানোর জন্য আমরা কেউ পড়িনি ওই ছেলেদের কলেজটাতে। কেন পড়েছি-- সেটা বলা অবশ্য কমবেশি মুশকিলের বিষয়। অন্তত আমার জন্য তো তা-ই বটে! নাতিদূর-সম্পর্কের দু'টো ভালো-ছেলে মামাকে আমরা দুই পিঠেপিঠি ভালো-ছেলে ভাই, নিজেদের এবং পরিবারের মুগ্ধ চোখে, অনুসরণ না করলেও দেখে আসছিলাম, আমরা কলেজের কাবিল হওয়ার আরো বেশ ক'বছর আগে থেকেই। সেই ভালো মামাদের মধ্যে ভালোর সাধারণ যোগসূত্র একটাই ছিলো-- তারা দু'জনই নটর ডেমে পড়েছিলেন। আমাদের বাবা ছিলেন বংশের সরল সুতোয় প্রথম, আর সহপ্রজন্মা সহবংশীদের মধ্যে খুব সম্ভবত একমাত্র, গ্র্যাজুয়েট। তাঁর পৌঁছানো হয়নি রাজধানীর এমন উঁচুদামের কলেজ পর্যন্ত। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ-ই ওই অঞ্চলের ওই আমলের জন্য ছিলো গুরুতর বিষয়। তো, সেই মামাদের সুবাদের সাথে আরো কোনো এক বা একাধিক স্পিলওভার কারণের মিলিত ফলে তাঁর (আমার বাবার) খুব বড় শক্ত সোজা ইচ্ছে ছিলো-- দুই ছেলেকেই পাঠাবেন কলেজ নামের বাতিঘর নটর ডেমের দিকে।

আমরা ভালো ছেলে। আমরা ভালো ছাত্রও ছিলাম, অন্তত ওইকাল পর্যন্ত। আসোলে, খারাপ ছেলে বা খারাপ ছাত্র যে কেন বা কীভাবে হ'তে হবে-- সেটাই তো বুঝে পাইনি ওই সাবালক বয়েসেও! পরপর দু'বছরে দু'ভাই দু'টো ছোট ছোট শরীরের মধ্যে যথেষ্ট মফস্বল-মগড়া আর বড় দু'টো কলজে নিয়ে রাজধানীতে এসে শুধু এই একটা কলেজেই ভর্তিপরীক্ষা আর সাক্ষাত্কার দিয়ে, ঠিকই টিকেও গ্যালাম, মনে হ'লো যেন চাঁদে নামলাম চতুর্থ আর পঞ্চম মানবসন্তান হিসেবে! ভাই আর্টস জি-তে, আর আমি সায়েন্স ওয়ান-এ। ভর্তি হওয়া পর্যন্তই সেটার কারণ আমাদের দু'জনের কাছেই ওই একটাই শুধু-- বাবার ইচ্ছে। ভর্তি হয়ে, একদম নবীনবরণ থেকে শুরু ক'রে কলেজ সাময়িকী 'চিটচ্যাট' আর 'ঢাকঢোল' পড়তে পড়তে আর ধীরে ধীরে লম্বা সময় নিয়ে অন্য বই আর অন্যান্য কিছু হালকা পতনও পড়তে পড়তে, আবিষ্কার আর অধিকার ক'রে নিলাম ওই কলেজে পড়ার উত্তরোত্তর অহংবোধ। না, এটা বিশ্বজয় না মোটে, তবু ওই ছোট প্রাণ আর ছোট ছোট চোখগুলোর জন্য ওই আপন আপন কিন্তু উঁচু আলোর হাতছানি কতো সুন্দর কতো বড় ছিলো-- সেটা ওই কলেজের ছাত্র মাত্রই বলতে পারবেন বুকে হাত দিয়ে, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

গল্পের শুরুতে উল্লেখিত বিখ্যাত অতিরিক্ত রসোক্তিটি আমার বা আমাদের কলেজের অন্যতম কিংবদন্তি, বাংলার রসময় শিক্ষক মোক্তার আহমেদ চৌধুরী'র। তাঁর জুতোয় দেখে চুল আঁচড়ানো যায়, তাঁকে একের বেশি দিন এক জামা-প্যান্ট পরতে দেখা যায় না কখনও, তাঁর চশমা-ঘড়ি-বেল্ট-জুতোও বদলে বদলে যায় প্যান্ট বা অন্য আরো কিছুর সঙ্গে রঙে-ঢঙে ঠিকঠাক ম্যাচ করানোর শখে কিংবা সুখে, তাঁর ভাষাও শার্ট-প্যান্টের মতোই নিয়ত ইস্ত্রি করা, সবসময় অতিরিক্ত শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন তিনি, ব্যাকরণের প্রত্যেক অধ্যায়েই তাঁর গোটা চার-ছয় দৃষ্টান্তমূলক গল্প আছে (যেগুলোর প্রায় সবই নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব'লে দাবির ঝলকে বর্ণনায় যথার্থই উজ্জ্বল), স্মরণীয় ঘটনা বিষয়ক প্রবন্ধ রচনার চিরায়ত আলোচনায় তিনি "তোমার খাতার প্রথম পাতায় / যেদিন আমি থাকবো না / আঁকবো না, লিখবো না, কল্পনা" ব'লে ব'লে হরলাল রায়ের জীবনোদ্ধার ক'রে ছাড়েন, তাঁর চোখ-জিভ্-মন-মাজা সবই খুবই রসে-কষে টইটম্বুর টসটসে-- এরকম আহারে-বাহারে মজার গল্প তাঁকে নিয়ে প্রবাহিত প্রচলিত আছে আরো হাজারে হাজার।

প্রাণিবিদ্যার গাজী আজমল আর মিজানুর রহমান ভুঁইয়াদেরও বিচিত্র রসিকতা; রসায়নের রস-কষ সব ছুটিয়ে দেয়া এসিডিটি(!) [অমর চাঁদ দাস তালুকদার]'র 'সাইলেন্ট-বাট-ডেডলি' বোমাবাজি আর বিদ্যাসাগরের নদীকূল-সুলভ 'হেই মিয়া' 'ওই ব্যাটা' সুরের পেঁজা পাতলা ঝাড়িবাজি; পদার্থের ক্লাসে গল্পে গল্পে ফাদার পিশোতো'র একের পর এক 'সূত্রু' আবিষ্কার; ম্যাথম্যাট্রিক্স(!)-এর মুকুটহীন রাজা নিমাই চন্দ্র দাসের বিস্ময়কর সব উপমার সাথে মিশিয়ে গণিতের দ্রবণকে লঘু এবং সহজ করার বিস্ময়কর কৌশল আর সব ধরনের গণিতের নিজস্ব অনন্য মেথডায়ন(!); গণিতেরই অন্য শিক্ষক জওহরলাল সরকারের 'স্যার স্যার' সম্বোধনে অগাণিতিক সব জেনারেল-পনা (হোমওয়ার্ক না করার গণ-অপরাধে একটা কলেজের একটা পুরো গ্রুপকে সূর্যের দিকে চোখ রেখে রোদের মধ্যে দুই ঘণ্টা বসিয়ে রাখার শাস্তির কথা অসামরিক কিংবা অনটরডেমিক কোনো ছাত্র কখনও চিন্তাও করতে পারেন কি?! আমার ঠিক জানা নাই।); বাংলা'র (বিহারের আর উড়িষ্যার না হ'লেও!) গ্যাব্রিয়েল মানিক গোমেজের রাজা-উজির-বধ পর্যায়ের চোয়ালচর্চা; ইংরেজির সুশীল স্যারের সত্যি সত্যিই তাঁর নামের প্রতি শতভাগ সুবিচার আর জাহাঙ্গীর আলমের অল-সিজন দামাল তুমুল খ্যাপা পাগলামি; পুরো দেড় বছর ধ'রে ভীষণ আশা ক'রেও একটাও ক্লাস পেলাম না ইংরেজির যেই অল্পদেখা-সুন্দরী শারমেন রড্রিক্স-এর-- তাঁর, কিংবা নিয়তির আরো এক নিষ্ঠুর পরিহাসে আমরা কলেজ শেষ ক'রে প্রায় বেরিয়ে যেতে যেতে অ্যাতো অ্যাতো লেট-টিনেজ ছেলের অনুন্নত বুকে প্রচণ্ড আফসোসের ধোঁয়া জ্বালিয়ে কেবল-ঢোকা অর্থনীতির মারকুটে সুন্দর শিক্ষিকা হোসনে আরা মৃধা'র রূপ-কথা-- এমন ক'রে আরো অন্যদের নিয়েও অন্য নানা গল্প আছে প্রচুরের চেয়েও বেশি। সেগুলো আপনি এমনিতেই আরো অনেক জায়গায় শুনেছেন শুনছেন শুনবেন, কিংবা আপনিও আমার সতীর্থ হয়ে থাকলে আপনিও অন্যদেরকে বলেছেন বলছেন বলবেন। উত্তরজীবনের জন্য গল্প-মহাগল্পের একটা মস্ত বড় কারখানা এই নটর ডেম কলেজ। এই দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সবার সমস্ত গর্ব-আলাপন, আস্ফালন আর জাবর-কাটাকাটির সমষ্টির মধ্যে, সবচেয়ে বেশি গল্প খুব-বোধ-করি এই কলেজেরই হয়েছে। সম্মিলিতভাবে ক্যাডেট কলেজগুলোর গল্প হঠাত্ হ'লে হ'তেও পারে এরচে' বেশি, কিন্তু এককভাবে কোনো কলেজ নিয়ে আড্ডায় গড্ডলিকায়, যেকোনো জায়গায়, গল্পে মনে হয় আমার কলেজই সর্বোচ্চ গোলদাতা (গোল-এর সকল অর্থে)।

নবীনবরণের মধ্যেই হাতে পাওয়া 'ঢাকঢোল'-এ দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রের একটা লেখায় একটা সত্যি গল্প পড়েছিলাম, তারও একটা প্রথম অভিজ্ঞতারই গল্প সেটা। ভর্তিপরীক্ষা বাবদ প্রথমদিন কলেজে পা দিয়েই, আলিঝালি মলিন শার্ট-প্যান্ট পরা এক বিদেশীকে তিনি দেখেছিলেন-- কলেজ করিডোর ধ'রে হেঁটে হেঁটে অন্যপ্রান্তের কোনো রুমে যাচ্ছিলেন সময়, নিচে একটা পরিত্যক্ত দুমড়ানো কাগজ প'ড়ে আছে দেখতে পেয়ে, মাটিতে নুয়ে হাতে তুলে নিয়ে আবার আরো কতোটা পেছন হেঁটে করিডোরের পাশের গার্বেজ বক্সে সেটার সত্কার ক'রে তারপর আবার আগের দিকে হেঁটে যেতে। পরে, ভর্তির পরে, নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বিস্ময়ে বিস্ফারিত হ'তে হ'তে সেই ছাত্র জানতে পেরেছিলেন-- সেই বিদেশী লোকটিই এই কলেজের প্রিন্সিপাল, ফাদার জে এস পিশোতো।

আমার কলেজের গল্প এমন সত্ সত্যি কিছু অবাঙালী মাটির মানুষের গল্প-- যাঁরা শিশুর মতো স্বচ্ছ শুভ্র সরল; যাঁরা ভিনদেশী ভিনভাষী হয়েও বছরের পর বছর বহু কষ্টেসৃষ্টে বাংলা শিখে আমাদেরকে মূলত বাংলাভাষায় পড়ান। আমার কলেজের গল্প এমন কিছু বিরল বাঙালী পণ্ডিতেরও গল্প-- যাঁরা সত্যকালের কিছু অন্তত আলো-অবশেষ আমাদের মুখের সামনে উপস্থিত করতে পেরেছেন অনন্ত রূপে। আমার কলেজের গল্প ইংরেজির জাহাজের ঘুমভোলা নাবিক আর ইংরেজি সাহিত্য-সাগরের ভয়ভোলা ডুবুরি টেরেন্স পিনেরো'র গল্প-- যাঁর শৃঙ্খলার-পরাকাষ্ঠা মা নাকি ওই বিবাহিত, মেয়ের-বাবা এবং কলেজ-শিক্ষাপরিচালক-ছাত্রউপদেষ্টা বয়সেও ঘুম থেকে উঠতে নির্ধারিত সময়ের থেকে একটু দেরি হয়ে গেলে তাঁকে সকালের নাশতা দিতেন না; কলেজেও যাঁর টয়লেটেও সবসময় একটা না একটা বই থাকতো, যেন পড়বার ওই অতোটুকু সময়ও জীবন থেকে বাদ না যায় জৈবিক আপদের আছরে। (ধ'রে নিতাম) রাতজাগা পাঠে (এবং ছোট্ট আমাদের আরো একটা বড় ধ'রে-নেয়া অনুযায়ী, হয়তোবা, পানেও) রক্তলাল হয়ে থাকা চোখে তিনি যেদিকে তাকাতেন, সেদিকে যেন তরুলতা-পশুপাখিও একসাথে এক ঝটকায় সব সারি সোজা ক'রে নিশ্চুপ ব'সে পড়তো তাঁর নিয়ম-শৃঙ্খলার ক্লাসে! কলেজের ছাত্র উপদেষ্টা বা শিক্ষা পরিচালকের অনেক কড়া কঠোর হ'তেই হবে, ওটা হয়তো বলবার মতো বিশেষ বিষয় না কোনো। কিন্তু, "আমি যদি তোমাকে একটা লাথি দিই, আর তুমি যদি ফাদার পিশোতোকে গিয়ে বলো-- 'টেরেন্স স্যার আমাকে লাথি মেরেছে', তাহ'লে ফাদার পিশোতো আমাকে কিছু বলবেন না, বরং উনিও তোমাকে আরেকটা লাথি দেবেন"-- এমন কথা বলবার মতো ক্ষমতা বা অহং বুঝি দরিদ্র মনের এই পোড়াদেশে শুধু নটর ডেমেই এবং এমনকি হয়তো শুধু টেরেন্স স্যারেরই ছিলো। ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রদের সঙ্গে কথা ব'লে পড়াশোনার ভিতরে-বাইরে সব সমস্যার সমাধান যেমন করতেন তিনি, তেমনি কোনো ছাত্র নিজেও সমস্যা হয়ে উঠলে তার ওপর সবচেয়ে সমীচীন সবচেয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি কখনই এতটুকু ট'লে ওঠেননি, কখনই টলেনি তাঁর শৃঙ্খলা, কখনই ভাঙেনি কলেজের অ্যাতো অ্যাতো ছাত্রের পায়ে শুভতম আশীর্বাদ হিসেবে পরিয়ে দেয়া সেই নিয়মের শৃঙ্খল। কলেজ ছাড়ার অ্যাতো বছর পরেও, টেরেন্স স্যারের মৃত্যুসংবাদ কী যে ভারি হয়ে এসেছিলো কানে, কতোদিন যে চেপে ব'সে ছিলো বুকে! কতো কতো দুষ্টু মেধাবী ছাত্র যে আমাদের পূর্ব-উত্তরকালে এই কলেজে ঢুকে দুষ্টুর চামড়া খুলে ফেলে মেধার নতুন সংস্কৃত রূপ নিয়ে নতুন মানুষ হয়ে বেরিয়েছে, সে তো নটর ডেমের পিতৃপ্রতিম ক'জন আদর্শ শিক্ষক আর তাদের আপোসহীন নিয়ম-দর্শনেরই জোরে।

আমার কলেজের গল্প বাংলার আরেকজন ভিন্নমার্গীয় শিক্ষক গিয়াস শামীম চৌধুরীরও গল্প-- যিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডঃ আবু হেনা মুস্তফা কামালের ভাবশিষ্য, এবং নিজেও সেই গুরুর মতোই নিজের ছাত্রদের সাথেও ব্যক্তিসম্পর্কে গভীর হওয়ার চেষ্টায় মুখ-নাম-রোলনম্বর চিনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে 'কাস্টমাইজড' পাঠদান ও মূল্যায়নের যত্নে অনন্য ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্রত্ব থাকাকালীনই একবার কলাভবনে বাংলা বিভাগের বারান্দায় তাঁর সাথে আবার দ্যাখাও হয়ে গ্যালো যখন, সেই ওজনদার মাপা হাসি-সমেত তাঁর সেই চেনা মূর্তির সঙ্গে আমার চোখাচোখিতে সেই পরীক্ষাও হয়ে গ্যালো-- তিনি আমাকে চিনতেও পারলেন। আমার কলেজের গল্প আমার আরেক বিস্ময় ব্যক্তিত্ব, উদ্ভিদবিদ্যার জাদুকর শিক্ষক অমল কৃষ্ণ বণিকের গল্প-- যাঁর দৃষ্টি, ভাব, বচন, আচরণ সবই দেখেছিলাম অনন্য। বিভিন্ন রঙের চক ব্যবহার ক'রে ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকতেন লিখতেন খালিহাতে নিখুঁত সব সরল-বক্র রেখা-বৃত্ত আকার আকৃতি। ক্লাসে এসেই হাতের ঘড়িটা খুলে রাখতেন ডায়াসে, একটাও অন্য কথা বলতেন না পড়ার বিষয়ের বাইরে, যেই ক্লাসের আলোচ্য অধ্যায়ে ঠিক যা যা পড়ানোর কথা বা পরিকল্পনা, পুরোটা শেষ করতেন মাপে মাপে আর ক্লাস শেষের ঘণ্টাটাও বাজতো ঠিক তখনই। আমাদের ওই বিস্ময় চূড়ান্তে পৌঁছে, যখন কিনা বিরোধী দলীয় অসহযোগ-ধর্মঘটের নানামুখী ঝামেলার মধ্যে অন্য কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাই সে-বছর ঠিকঠাক পাঠক্রম শেষ করতে না পারলেও এক বণিক স্যারই একইভাবে শেষ ক্লাসের শেষ মুহূর্তে পাঠক্রমের শেষ অধ্যায়ের শেষ কথাটি বললেন! কী যে এক ঘোরলাগানো নাটকীয় পরিসমাপ্তি! সবশেষে, আমার কলেজের গল্প খুব দুঃখের সাথে আমার অত্যল্প-সামাজিক কলেজ-জীবনের একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাসিরেরও গল্প-- যার সঙ্গে ঢাকা শহরের এদিকে ওদিকে রিকশায় আর পায়ে চ'ড়ে ঘুরে ঘুরে, কৃষ্ণচূড়া দেখে, রেস্টুরেন্ট আর অ্যাপার্টমেন্ট দেখে দেখে, ঢাকা শহর একটু একটু ক'রে চিনেছিলাম মফস্বল থেকে আসা সহজ সরল এই আনাড়ি আমি। কলেজ শেষের পরেও ওর সাথে হালকা হ'লেও একটা চিঠি-যোগাযোগ আমার ছিলো। কিন্তু, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়ে হল-এ না উঠে একা একা একটা বাসায় থাকতো সে, তারপর এক সময় আচরণ-কথাবার্তা একটু একটু ক'রে অস্বাভাবিক অসংলগ্ন হয়ে একসময় পুরো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো, খবর পেয়ে ঢাকা থেকে তার পরিবার গিয়ে তাকে নিয়ে এলো, তারপর তার আর কোনো হদিস পাওয়া গ্যালো না। তার কোনোকালের কোনো বন্ধুই তাকে আর খুঁজে পেলো না আর কোনোদিন।

কলেজের সুবর্ণ জয়ন্তীর পুনর্মিলনীতে যোগ দিতে আমি যাইনি, কলেজের হারানো সময়টা নিয়ে পলায়নপর আমার অনেকই মন খারাপ হবে ব'লে। এখন কখনও কলেজটার কাছে দিয়ে কোথাও যাওয়া পড়লে, এ বিষয়টাও মনে হয়ে একটা কেমন ভালোও লাগে খুব, যে কলেজের এখনকার নতুন ভবনটাতে আমাদের পড়া না হ'লেও সেটার নির্মাণের ইট-সিমেন্টে আমারও ছোট্ট একটু স্থায়ী অংশগ্রহণ ছিলো। আর, আজ পর্যন্ত যেখানেই কোনো নটর ডেমের ছাত্র পাই বর্তমান কিংবা প্রাক্তন, খুশিতে সবগুলো দাঁত বেরিয়ে যায় ভীষণ এক সাজাত্যবোধে। ব্লগিং শুরু ক'রেও যে নির্দিষ্ট আয়তনটাতে ভিড়লাম আপন জ্ঞান ক'রে, সেখানেও যে বিভিন্ন বয়সের অ্যাতো অ্যাতো তরতাজা বালক নটরডেমিয়ান বেরুলো, এটা দেখেও যেন জায়গাটা আরো অনেক অনেক বেশিই আপন হয়ে গ্যালো।

কলেজের দেড়টা বছর যেন খুবই সশ্রম একটা জেলখানায় ছিলাম। হাজার হাজার ক্লাবের কলেজ নটর ডেমেও টুকটাক ক্রিকেট-ফ্রিজবি'র বাইরে আর কোনো একস্ট্রা-কারিকুলার কিছুতেই আমি ছিলাম না। প্র্যাকটিক্যাল আঁকতে লিখতে জীবন বের হয়ে যেতো সারা সপ্তাহ। তার ওপর আবার কুইজ চালু থাকার পুরো মৌসুমগুলোতে মোটামুটি নিয়ম ক'রেই প্রতি সপ্তাহে দুই রাত একেবারেই ঘুমাতাম না-- ক্লাসের সাথে ঠিকঠাক পড়া কাভার না করতে পেরে কুইজ-পরীক্ষার পূর্বরাত্রিতেই, নোনা নোনা গ্র্যান্ড চয়েস বিস্কুটের প্যাক হাতে কোনোমতে বইয়ের ওপর উপুড় প'ড়ে থেকে, হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে সাগর-দিগন্তের কিনারে পৌঁছাতাম একেবারে ভোরের পরে সূর্যের সাথে সাথে। নিজের ইচ্ছার সাথে মিল হয়নি যদিও, তবু বাবার পরবর্তী স্বপ্নও পূরণ করতে পারার জন্য যথেষ্ট পড়াই যে আর পড়তে পারলাম না পরের আরো বড় ভর্তিপরীক্ষার জন্য, সেটারও অন্যতম একটা কারণ ব'লে আমি চিহ্নিত করবো  আমার মতো অযান্ত্রিক হ্রস্যদৃষ্টি মানুষের সেই দেড়বছরের ভয়ঙ্কর ক্লান্তিকর জেলখাটা-টাকেও। যখন একবার ছাড়া পেলাম সেই কারাগার থেকে, তখন স্বাধীনতার দীর্ঘ ক্ষুধায় একেবারে স্বরাজ বসিয়ে নিলাম নিজের দুনিয়াতে। ভাবটা এমন, যেন-- "অনেক পড়া হয়েছে বাবা! এবার উঠে প্যান্টের ধূলোটা ঝেড়ে নিয়ে একটু জানালার বাইরেটায় চোখ দাও, চোখ দাও নিজের অন্য ভিতরে।" শরীর আর মস্তিষ্কের এত পরিশ্রমে অমানুষ ব'নে গিয়ে কলেজে থাকার ওই সময়টাতে সত্যি সত্যি মনে হ'তো-- পরিচিত পরিজনের আর কোনো ছেলেকে আমি অন্তত এই কলেজে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ আর দেবো না এই জীবনে। আর, এখন, আরো অনেকটা পথ অনেকভাবে পাড়ি দিয়ে, পৃথিবীর আর নিজের সঙ্গেও আরো অনেক বোঝাপড়ার পরে, বাইরে থেকে দেখে পরে বুঝি-- আমরা এখন যে যা-ই হয়েছি, যতোটুকুই বা দূরত্ব অতিক্রম করেছি, যেখানেই আছি, যেভাবে জীবন দেখি, সবকিছু ভেঙে পড়ার ঘোর দুঃসময়েও যতোটুকুই আলো আর যন্ত্রণা এখনও ধারণ করি সমান সমান্তরালে, এই সবকিছুর পিছনে শীর্ষ তিনটা কারণ বা নিয়ামকের একটা অবশ্যই আমাদের কলেজ, সারাজীবনের গৌরবের প্রিয়তম প্রাঙ্গণ-- আমাদের, আমার নটর ডেম কলেজ।

[২০.০৫.২০১০
মহাখালী, ঢাকা]

[জুলাই ২০১০-এ সচলায়তন থেকে প্রকাশিত 'কলেজ-স্মৃতি' ই-সংকলনে পূর্বপ্রকাশিত]

৪টি মন্তব্য:

অনার্য সঙ্গীত বলেছেন...

এইটার আরো পর্ব লেখেন ভাই। অনেক না বলা গল্প রয়ে গেছে...

নুশেরা তাজরীন বলেছেন...

আরেকটা মন্তব্য লিখেছিলাম, গেছে কিনা বুঝতে পারছি না :(

উৎকৃষ্ট রচনার সঙ্গে রসবোধের সূক্ষতার এমন সংযোগ বড় কম দেখা যায়! তুমি এতো কম লেখো কেন?!!

তোমার বন্ধু নাসিরের জন্য কষ্ট হচ্ছে...

সাইফুল আকবর খান বলেছেন...

@ সঙ্গীত! ভাই, জানিসই তো, আমি এক অলস ফাঁকাফাঁকিবাজ মানবেতর লেখক(!)। চেষ্টা করেছিলাম ওই একটার মধ্যেই অন্তত প্রকারগতভাবে সবই ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার। তবু, দ্যাখা যাক, কোনো সামনের কালে আবার হয় কি না ওইকালের কোনো মন্থন। মাথায় রাখলাম তোর পরামর্শ। পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো। :-)

সাইফুল আকবর খান বলেছেন...

@ আপা! আপনার এমন সহৃদয় শংসা আমাকে বরাবরই লজ্জিত করে। আবারও লজ্জা পেলাম খুশির সাথে সাথে। :-) আমি কম লিখি কেন-- এ প্রশ্নের জবাবে কী বলি, বুঝতে পারছি না, অনেস্টলি অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ মডেস্টলি।
আর, হ্যাঁ, নাসিরের জন্য এখন পর্যন্ত হঠাত্ হঠাত্ আমার মন কেমন করে! ভিন্ন ভিন্ন কারণে হ'লেও আমার জীবন থেকে বন্ধু এমন নিখোঁজ হয়েছে কয়েকজন। প্রতিটাই খুব বেদনার, কিন্তু তার মধ্যেও নাসিরেরটা আরো একটু বেশিই। ভালো থাকেন আপা। কী ঝটপট আপনি প'ড়ে-ট'ড়ে জানান দিয়ে যান অতো ব্যস্ততার মধ্যে, কী আর বলবো! ঋণ যোগ হয় পদে পদে। :-)
[ওহ্, না, এটা ছাড়া আর কোনো মন্তব্য পড়েনি এখানে আগে। কোনো অন্য ঝামেলায় ওটা আগেই মিসিং হয়ে গিয়ে থাকবে।]