ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] চর্চাপদ ০৮

১.
কর্মের শুদ্ধ সঠিক মান নির্ণয় এমনিতেই দুস্কর, তাও আবার নিজ কর্মের বেলায় এই মূল্যায়নের চেষ্টা তো রীতিমতো তস্করের সাধনার মতোই নিচু কাজ! তবে, পরিমাণে আমার কর্ম মোটামুটি বহুদিকে বহুতবু আমি ঠিক কর্মী নইতারচে' বেশি বরং কর্মক্লান্তঘর্মসিক্ত হয়ে গরমের চরমভাব থেকে পালাতে যাই, শীত খুঁজতে ধাই, কম্বলে মুখ গুঁজতে চাইশীত জুটুক আর না জুটুক, আমি ঘুমন্ত! আমার মতো ঘনঘন শীতনিদ্রা বোধ করি খুব কম মানুষই চাষ করেছে নিজের মূল্যবান জীবনেএকমাত্র জীবনের কতো কতো 'সম্ভাবনা'কে যে আমি ঘুমের ঘোরে পায়ে নেড়ে ভেঙে দিয়ে 'সম্ভব না' 'রে দিয়েছি, সেই হিসেবও পাইপাই করতে চাইলে তার জন্যই আসোলে আর একটা পৃথক জীবন চাই!

নেত্রকোণার এক বা একাধিক 'লম্বা কিস্সা'য় (পালাগানে) কুদ্দুস বয়াতির মুখে বহুবার বহুভাবে শোনা একটা চয়ন- "আঁইট্যা যাইতে ফাও চলে না, মনডা ক্যামন করে"! যাদের কাছে এটা হিব্রু'র কাছাকাছি দুর্বোধ্য লাগছে হঠা, তাদের জন্য বলি- 'আঁইট্যা' হচ্ছে 'হেঁটে' (হেঁটে > হাঁইট্যা > আঁইট্যা), 'ফাও' হচ্ছে 'পা' (পা > পাও > ফাও), আর 'মনডা' তো 'মন-টা'আর বাদ বাকি সব শব্দ আশা করি এর মধ্যে পরিষ্কার তো, আমার দশাও আসোলে এই অকালবার্ধক্যের মধ্যে বহুবারই বারবারই বরাবরই "আঁইট্যা যাইতে ফাও চলে না, মনডা ক্যামন করে"!

২.
সচলায়তনের মতো প্রিয় আয়তনেও আমি যে আদৌ কতোটা সচল, সে তো মোটামুটি বয়সী সচলমাত্রেই জানেনকর্মক্লান্তির সাথে সাথে আমার হতাশাবাদী ভ্রান্তির ঘেরাটোপটিও দেখে ফেলে থাকবেন কেউ কেউআজ যে না-পারার না-হওয়ার গল্প করতে বসলাম, সেগুলোর সবই শুধু কাজের বহুভাঁজের ক্লান্তি নয় বটে, মতে-পথে মিলতে বা মিলাতে না পেরে ছেড়ে-দেয়াও সেখানে কম নেই একেবারে! ঠিক সরব দ্বন্দ্ব তেমন না হ'লেও, আদর্শিক বা বৈশ্বাসিক মোহভঙ্গও ঘটেছে আমার খুব তাড়াতাড়িই
প্রায় প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হয়েও দুই বছর জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত ক'রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীচী-ই ছাড়িনি শুধু, পরেও একটাতে ছয় মাস চা-পুরি এনে আর অন্য আরেকটাতে তিন বছর প্রায়-চণ্ডীপাঠ ক'রেও ছেড়েছি আরো দু'টো নাটকের দল
শেষ দলে দলাধিকর্তার সাথে ব্যাপারটা আমার কাছে এমনই একটা নীরব স্নায়ূযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল শেষভাগে, যে তাকে গুরু মেনে শ্রদ্ধা করা তো দূরের কথা, 'ভাইয়া' ডেকে তার অধীনে কাজ করাটাই আমার নিজের কাছে লজ্জাজনক ঠেঁকছিলকাগজে কলমে পদত্যাগবার্তা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ফ্ল্যাট-মেট দপ্তর সম্পাদকের হাত দিয়েদলনেতা পত্রপাঠ প্রতিক্রিয়ায় প্রথমের 'বজ্রাহত' (পরে দপ্তর সম্পাদকের দেয়া ভাষ্যমতে) অভিব্যক্তি কিছুক্ষণের চেষ্টায় মুছে পরে সেই দূতকে নাকি বলেছিলেন- "ছেড়ে দেয়াটাই আসোলে সহজ, 'রে রাখাটা অনেক কঠিন"! আমি তার ছায়ারও নাগাল আর না মাড়িয়ে সেই অপমান-অপবাদই মেনে নিলাম নিজেকে খুইয়ে ওরকম কিছু ধ'রে রাখাটা আসোলেই আমার পক্ষে ভীষণ কঠিনতারচে' আমার সহজ স্বকীয় অহম্ই আমাকে শান্তি দিয়েছে, অন্তত নিজের বিবেকের কাছে ভালো রেখেছে

৩.
বিবেকের নিন্দেমন্দ তবু আমাকেও শুনতে হয় অন্যত্র, যে কথা বলবো ব'লে আসছিলাম এদিকে, সেই অকর্মিতার জন্যইসে কথাতেই আসছিরাজনীতির বাস্তব চেহারা আগেই চেনা হয়েছিলতাই দিন বদলের স্বপ্নগ্রস্ত থেকেও ছাত্ররাজনীতির টেবিলের ধারেকাছেও চা খেতেও যাইনি কখনও'উদীচী' নামক সার্বক্ষণিক 'সামাজিক আন্দোলন'টা ধ'রেও ছেড়ে দেয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল দু'টো ঘটনায় অনেক বেশি খেপে গিয়ে সাধারণ প্রতিবাদী ছাত্র হিসেবেই মিছিল-মিটিং-টিয়ারগ্যাসের মধ্যে গিয়েছিলামএকটা শামসুন্নাহার হল-এ পুলিশের বর্বরতার সেই ২৩ জুলাইয়ের কালো রাতের ঘটনা, আর আরেকটা ছিল হুমায়ুন আজাদ স্যারের ওপর নৃশংস হামলাকিন্তু, প্রায় একইভাবে, আন্দোলনের কয়েকদিনের মাথায় খুবই আপত্তিকর দৃশ্যে রাজনীতির সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় বুকের ভেতর উপায়হীন কান্না চেপে ঘরে ফিরেছি সেই দু'বারইপাশের সহযোদ্ধাই যখন প্রত্যেকটা প্রতিপক্ষের গুপ্তচর, তখন যুদ্ধটাই বা করবো কোথায়!
আস্তে আস্তে পত্রিকা পড়াও ছেড়ে দিয়েছি, খালি দুঃখজনক আর ঘৃণ্য খবরাখবর প'ড়ে অসহায় নিরুপায় যন্ত্রণা নিয়েই মুখ বুজে ব'সে থাকতে হয় ব'লেদিনদিন তবু হাওয়ায় চ'ড়ে বেড়ানো দুঃসংবাদ আর কুসংবাদগুলোর আস্ফালনে খালি বুঝতেই থাকলাম- এই দেশে নির্বাচনও হয় শ্রেফ এটা ঠিক করার জন্য, যে আগামী পাঁচ বছর টিভি-তে কার মুখের ভেংচি দেখতে হবে, টেন্ডারবাজি আর জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সমস্ত দুর্নীতি করার পালাটা কাদের হবে, কোন্ দল এই পাঁচ বছরে অন্য দলের ছেলেদের মাথায় রেঞ্চ কিংবা ড্রিল মেশিন চালাবে, আর পুলিশই বা এই সময়টাতে কোন্ দলের 'ছাত্র'নেতাদেরকে সেই খেলাগুলো খেলার পরিবেশ নিশ্চিত ক'রে দেবে সব সময় পাশে পাশে থেকে! তো, আমার ভোট দেয়ারই বা কী দরকার! আমার জন্য কোনটা আটকাবে কোথায়!

৪.
দুশ্চরিত্র পথের চিন্তায় প'ড়ে থেকে প্রত্যেক দুপুরে একবার ক'রে লজ্জা-ঘৃণায় মরবো না ব'লে, চোখ বুজে ভ্রূ কুঁচকে কয়েকবার যান বদল ক'রে কোনোমতে পথ পেরিয়ে এসে ফ্লুরেসেন্ট অফিস-পাড়ায় ঢুকলাম সাত-পাঁচের প্যাঁচ-পয়জারের বাইরে নিরীহ নিপাট ছাপোষা হয়েই শ্রেফ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে বেঁচে থাকবো ব'লেকিন্তু অফিসেও প্রতি কিউবিক্যালে প্রতিদিন কাজনীতির সঙ্গে আসে রাজনীতিওসামনের চেয়ারে ব'সে খিলান দিয়ে দাঁত খুঁচাতে খুঁচাতে, কথাও ব'লে যায় বেঘোরে থুথু ছিটিয়ে
মুক্তিই আসোলে আসলো না এখন পর্যন্তকাজের মধ্যে কাজ যেটা হয় এই কুকাজের দুষ্টু ঘোরে,-- এতকাল পরে এরকম একটা আয়তনে আবার কিছু তুমুল তুখোড় দামাল কর্মী দেখেও, সঙ্গদোষে শুভ'র টানে ভেসে গিয়ে আবার আশা আবার কর্মের দলে হাত উঠিয়েও একবার দু'বার বারবার, দিনের শেষে কিন্তু নিজেই নিজেকে এখনও খুঁজে পাই না সেই রোজকার কর্মীতালিকায়! রুটি-রুজির লোক হয়ে যাওয়া এই খরচ জীবনে বাণিজ্যশিল্পের বিশ্রী ব্যস্ততায়, বিষণ্ন বিপন্ন দৌড়ে বেড়াই শুধুউইকিযুদ্ধের ডাকে উদ্বুদ্ধ হই, উত্তেজিতও হইউইকিপিডিয়ায় নিবন্ধন করি, কোন্ জায়গায় কাজ করা যায় ভাবতে ভাবতে একটু 'লেও সময় ক'রে ক'রে অল্পবিস্তর ঘুরিও কয়েকদিনকিন্তু শেষমেশ আমার আর যুদ্ধে যাওয়া হয় না এবারও। "যার হয় তার হয়, আমার হয় না"নিরন্তর কা.বি.খা. কর্মসূচিতে খাবি খাই, খাবিই খেতে থাকি; নিয়োগত্রাতা রাজার জীবন আরো তুঙ্গে উঠিয়ে দিতে "উঁচু ওই পাহাড়ে ধীরে ধীরে" উঠতে থাকি, 'ড়ে যাই, আবার উঠি, ... আর বিবেকের সেই পুরোনো আয়নামহলে যথারীতি "রয়েসয়ে কম্যুনিস্ট"ই হয়ে যাই আরো একবার! হয়তো ঠিকঠাক কর্মী নই ব'লেই পারি না
কতো বড় কাজের লোকেরা আরো কতো কাজ ক'রে আবার এমন ভালো কাজও করে, বরাহ শিকার করে, ধর্ষিত ইতিহাসকে পুনর্বাসন করেতবে, আমার কাজের দোহাই কি শুধুই আমার লজ্জাঢাকার নির্লজ্জ অজুহাত? আমিই শুধু পারি না? আমারই শুধু "আঁইট্যা যাইতে ফাও চলে না, মনডা ক্যামন করে"?! হায় কর্ম! হায় অ্যাকটিভিজম! ক'রেও শান্তি পাই না, না ক'রে তো আরো না!

৫.
পৌনঃপুনিক পচন আর সংক্রমণে মনেরই বুঝি গ্যাংগ্রিন হয়ে বসলো এতদিনে! তীব্র বিষযন্ত্রণা শুধু, শল্য অপসারণ ছাড়া বুঝি উত্তরণ মিলবে না আর!

[২৯ জানুয়ারি ২০১০ দিবাগত রাত ১২:২৫]
(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ৩০.০১.২০১০, ০২:২১)

কোন মন্তব্য নেই: