[নাটক, মোটামুটি ভালো মানের থিয়েটার, দেখলেই আমি চার্জ পাই। আর, আমার চার্জ পাওয়ার ফল বা সূচক হয় কিছু ভালো কাজের চেষ্টা ক'রে শীতনিদ্রাপুর থেকে কিছুদিনের জন্য বেরিয়ে আসা। সেইসব ভালো কাজের মধ্যেও লেখার চে' ভালো আর কিছুই হ'তে পারে না। এই কিছুদিন খুব বেশি ব্যস্ত ছিলাম বললে বাড়িয়ে বলা হবে, কারণ কাজের চাপে এমনই তার পেঁচিয়ে ছিল মাথার, যে আসোলে কাজের কাজ কিছুই হয়ে ওঠেনি। তাই, বড়জোর বলি- হ্যাঁ, চাপ ছিল বেশ বেশি। এখনও শেষ হয়নি সেই চাপ কাবাব। এখন এই গভীর রাতেও জেগে থেকে একটা প্রেজেন্টেশনের কাজ শেষ ক'রে সকালেই দাখিল করতে হবে ক্লায়েন্টের জন্য। তো, অফিসের জন্যও লিখতে যখন হবেই, সে-সময়েই নাটকের চার্জও জুটলো ব'লে কাজটা সম্ভব মনে হচ্ছে। তাই, ভালো কাজ শুরু করা যাক নাটকের প্রতি ঋণশোধমূলক একটা লেখার মাধ্যমেই।]
লেখার শিরোনামটা "নায়লা আজাদের বিসর্জন"ও হ'তে পারতো। সেটা যে হ'লো না, তাতে ক্ষতিও কিছু পোহাতে হবে না আপনার। বলছি তাঁর কথা। হ্যাঁ, আমাদের ছোটকালের ঢাকার মঞ্চ আর ছোটবড় পর্দার বড় তারকা নায়লা আজাদ নূপুর এখন আবার ঢাকায়, বেশ কিছুদিন ধ'রেই। মাঝখানে এতকাল দেশের বাইরে বিভিন্ন রকম বিভিন্ন দিগ্বিজয় ক'রে-ট'রে, হলিউডও ছুঁয়েটুয়ে আবার তিনি এসেছেন দেশে, কাজও করছেন দেশের মঞ্চে- এটা আমাদের মতো অনেকের জন্যই খবর হিসেবে ভালো। তাঁর শেষ অভিনয় দেখেছিলাম আবু সাইয়ীদের 'কীর্ত্তণখোলা' সিনেমায়। মাঝখানে বাইরে থেকে এসে সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি)'র 'রাজা' প্রযোজনাটিরও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। সেটা হয়তো ২০০১-'০২এর দিকে হবে। ঢাবি'র ছাত্র হিসেবে তখন বারান্দায় উঠোনে তার অনেক পোস্টার দেখেছি ঠিকই, কিন্তু দেখবো দেখি করতে করতে নাটকটা দেখা হয়ইনি আর। তো, তিনি যখন আবার দৃশ্যমান হ'লেন ঢাকার থিয়েটার হলগুলোতে, একটু পুনরাগ্রহী হ'তে হ'তেই থিয়েটার-বন্ধুদের মাধ্যমে কিছুদিনেই শুনলাম- বিভিন্ন নাট্যদলের এবং নির্দলীয় কিছু নাট্যকর্মী মিলিয়ে নিয়ে একটা রেপার্টরি থিয়েটারের ব্যানারে রবীন্দ্রনাথের 'বিসর্জন' নামতে যাচ্ছে ঢাকার মঞ্চে, এবং সেটার নির্দেশনা দিচ্ছেন নায়লা আজাদ। আজ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি'র এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল-এ দেখলাম 'দশরূপক' নামক সেই নতুন রেপার্টরি'র প্রথম প্রযোজনা 'বিসর্জন'-এর প্রথম প্রদর্শনী। ভালোই লাগলো। উড়ে যেমন যাইনি উত্তাল ভালোর তালে, আবার হতাশও যে হইনি সেটাও সত্যি।
"পেশাদার থিয়েটার পরিচালনা; আধুনিক ও প্রচলিত নাট্যধারা, নাট্যকৌশল ও পদ্ধতির সংমিশ্রণে নিরীক্ষাধর্মী নাট্যচর্চা করা; আন্তর্জাতিক মানের শিল্পসম্মত ও সময়োপযোগী থিয়েটার সৃষ্টি করা"র (মূল)লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করলো পেশাদার থিয়েটার সংগঠন "দশরূপক রেপার্টরি থিয়েটার"। ভালো কথা। তাদের লক্ষ্য পূরণ হোক। সফল হোক, মুখর হোক তাদের শিল্পরথ। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার না হ'লেও মঞ্চের এ সময়ের কয়েকজন কমবেশি তারকা অভিনয়শিল্পীর সাথে সাথে সম্ভাবনাময় অনেক নতুন মুখও নিয়ে নায়লা আজাদের সম্পাদনা ও নির্দেশনায় এই 'বিসর্জন' প্রযোজনাটি বিস্ময়-বিমোহিত না করলেও মানসম্মত, সম্ভাবনাময়, আশানুরূপ ভালো থিয়েটার- সেটা স্বীকার করতেই হবে।
নাটকের ঘটনা বা বিষয় সম্পর্কে একটু বলি। রাজা গোবিন্দ মাণিক্য তার রাজ্যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন কালী'র মন্দিরে পূজার নামে ধর্মের নিয়মে প্রাণের বলিতে রক্তের হলি। কিন্তু প্রতিরোধ আসে রাণী গুণবতী আর মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ রঘুপতির কাছ থেকে। মায়ের পূজার প্রশ্নে রাণীর অহম কোনোমতেই নতি মানে না শুভ-সুচরিত রাজার প্রেমের কাছেও। আর ধর্মাশ্রিত ব্রাহ্মণ এটাকে যেভাবে দ্যাখেন, তাতে ক'রে রাজা আর ব্রাহ্মণ যেন হয়ে দাঁড়ান ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মুখোমুখি দুই সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান। শান্তিকামী রাজার সহৃদয়তার সুযোগে রাজ্যের নাগরিকরাও দু'ভাগ হয়ে, মূলত বেশিরভাগই বলি-পূজাপালনেই মতি থাকে। কিন্তু রাণীর ইন্ধনে পূজা সাজে একদিকে, অন্যদিকে সৈন্যসমেত রাজা এসে সেটাও ভণ্ডুল করেন তার আদেশবলে। তাই, নীরবে অন্দরে রাজার অবস্থান রোষে উন্মত্ত ক'রে তোলে ব্রাহ্মণ আর রাণী দু'জনকেই। শিশুকাল থেকে ব্রাহ্মণের কাছে পুত্রের মতোই অনুগত থেকে বড় হয়েছে যে একান্ত সেবাদাস জয়সিংহ, তার মনে জাগে চরম দ্বন্দ্ব। এই তবে ধর্ম! সত্য তবে কী! ভক্তিপিপাসিনী দেবী কি তবে প্রকৃতই শুধু রক্তপিপাসিনী! তার উত্তরে সত্য-মিথ্যা ধর্ম-অধর্মের মায়ার তত্ত্বে ভুলিয়ে পেঁচিয়ে তাকে আরো বরং এলোমেলোই ক'রে তোলেন রঘুপতি। জয়সিংহের মন্দির-সেবা-সর্বস্ব জীবনের ভার এতে আরো যায় বেড়ে। হঠাতের চাঞ্চল্যে সে ধরা দেয় সাড়া দেয় অপর্ণার প্রেমাকুল আহ্বানে। কিন্তু রঘুপতি টিকতে দেননি সেই আকুলতাকে। তার আদেশে নিরুপায় হয়ে অপর্ণাকে মন্দির থেকে বিদায় ক'রে দেয় জয়সিংহ। রঘুপতি নতুন প্যাঁচ কষেন তাকে আরো বেশি আটকে ফেলে ওদিকে রাজার বিরুদ্ধেও তার রোষ চরিতার্থ করার জন্য। মা কালী স্বপ্নে তার কাছে রাজরক্ত চেয়েছেন- এই আজ্ঞা জয়সিংহকে জানিয়ে তিনি তাকে যেমন ক'রে তোলেন আরো দিকহীন বিচলিত, অন্যদিকে রাজার অনুজ নক্ষত্র রায়কেও তিনি এই ব'লে নীরব ঘাতক হিসেবে প্রস্তুত করেন, যে- রাজা গোবিন্দ মাণিক্যকে হত্যা ক'রে তার রক্ত রঘুপতির কাছে এনে দিতে পারলে নক্ষত্র রায়ই হবে সে-স্থলাভিষিক্ত পরবর্তী রাজা। সরল তরুণ নক্ষত্র রায় রাজা-হত্যা করতে পারে না বটে, কিন্তু রাজার আদরে কোলে-পিঠে বড় হ'তে থাকা অন্য কিশোর ধ্রুব'র বিরুদ্ধে তাকে লেলিয়ে দেন রাণী গুণবতী। গুণবতীর পরামর্শ আর সহযোগিতায় ধ্রুবকে বশ ক'রে বলির জন্য মন্দিরে নিয়ে যায় নক্ষত্র। ধ্রুবকে পেয়ে নিশিথ রাতেই বলির আয়োজন করেন পূজার-জন্য-রক্ত-পিয়াসী রঘুপতি। কিন্তু রাজা টের পেয়ে তার লোকজন নিয়ে এসে এই বলিও পণ্ড করেন, রক্ষা করেন ধ্রুবকে। এই ঘৃণ্য অপকর্মের জন্য নক্ষত্র রায় এবং রঘুপতিকে আট বছরের নির্বাসন দেন রাজা গোবিন্দ মাণিক্য। নক্ষত্র যায় নির্বাসনে। কিন্তু রঘুপতি তার এতকালের ধর্মাচারের দোহাই দিয়ে রাজার কাছে এ-রাজ্যে থাকার জন্য চেয়ে নেন আরো দু'টো দিন। দয়াপরবশ রাজাও মঞ্জুর করেন সেই দু'দিন। তবে এ সুযোগ নিয়ে কুচক্রী রঘুপতি আবার জয়সিংহকে আজ্ঞা দেন রাজাকেই হত্যা করতে। জ্ঞানহারা জয়সিংহ তার নিয়তি-বাঁধা ভক্তিতে মেনেও নেয় সেই আজ্ঞা। ব্রাহ্মণের ইঙ্গিতে আবারও বলিপূজার জন্য যখন চলতে থাকে বিপুল আয়োজন, রাণী-সহ নাগরিকদের উন্মত্ত হল্লাবোল, সে-সময় সবাইকে হতবুদ্ধি ক'রে দিয়ে হঠাত্ জয়সিংহ নিজেই এসে নিজের বুকে নিয়ে নেয় রঘুপতির হাতের শানিত ছুরি। হ্যাঁ, প্রাণ হারায় জয়সিংহ। এ ঘটনায় হতবাক হয়ে লজ্জিত অনুতপ্তও হন রঘুপতি। মহামায়ার মন্দির ভেঙে দেন তিনি। রাণী এসে দ্যাখেন পূজার জন্য মা-ই এখানে আর নেই। চেতন ফিরে পান রাণীও, রাজার কাছে ক্ষমাও চান। এভাবেই দেবী একবার বিলুপ্ত হয়ে রাজার মানুষীর মধ্যেই করলো পুনঃঅধিষ্ঠান। রাজ্যে রক্তের হলিও হ'লো বন্ধ।
বাড়তি কোনো বাগাড়ম্বর কিংবা আচার-আনুষ্ঠানিকতায় না যেয়েই সোজাসাপ্টা কাজের কথার মতো যখন শুরু হয়ে গ্যালো একটা দলের প্রথম নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন, শুরুতে এটা একটু ধাক্কা দিয়েছিল বটে। কিন্তু, ভেবে দেখলাম- এতে আসোলে সমস্যা কী আছে! বাহুল্যে অভ্যাস হয়ে গ্যাছে আমাদের, তাই ওইসব হাব-ভাব-বাহুল্য-বিবর্জিত সোজা জিনিস দেখলে কেমন যেন লাগে আজকাল! প্রযোজনার নকশা-পরিকল্পনা-সংগঠন বেশ দৃষ্টিনন্দন এবং পরিপাটি ছিলো। মন্দির, রাণীর অন্দর আর রাজ্যের বহিরাঙ্গন- এ তিনটিই দেখানো হয়েছে একই দৃষ্টিসীমার মধ্যে। যুগপত এই তিনটি অঞ্চলই বহাল ছিলো। আলো আর ঘটমান ঘটনার দ্বারাই শুধু প্রয়োজনমতো আলাদা হয়েছে সে ক্ষেত্রগুলো। দু'পাশে চলতে থাকা একইরকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে একইসাথে একই সময়ের মধ্যেই সমান্তরালে দেখানো হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। নাসিরুল হক খোকনের আলোক পরিকল্পনা বেশ উপযোগী আর কার্যকর মনে হয়েছে। নিজেদেরই করা সহজ সংগীত আর নৃত্য-চলন-বিন্যাসে কান আর চোখের জন্য সব মিলিয়ে স্বস্তিকরই ছিলো নাটকের সমগ্র সংঘটন।
১৮৯০ সালে 'রাজর্ষি' নামে যে নাটক লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেটার ওপর ভিত্তি ক'রেই আবার ১৮৯৩ সালে লিখেন এই 'বিসর্জন' নামে তার প্রথম কাব্যনাটকটিও। শেক্সপিয়ারের প্রভাব এই স্ক্রিপ্টে যথার্থই দৃশ্যমান। তবে, অন্য যে-ব্যাপারটি নাটকের প্রকাশনাপত্র প'ড়ে জানলাম, সেটি হ'লো- নায়লা আজাদের দৃষ্টিতে এ নাটকের স্ক্রিপ্ট ত্রুটিযুক্ত। তিনি অবশ্য বিলেত থেকে ফেরার পরপর রবীন্দ্রনাথের এই প্রথম-লেখা কাব্যনাটকে গঠনগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথাই ব'লে এটাকে "অবিশ্বাস্যরকমভাবে কাব্যময়, রূপকাশ্রিত এবং সমসাময়িক"ও বলেছেন। ত্রুটিমুক্ত না হ'লেও এটাকে স্বর্ণখনি জ্ঞান ক'রেই এ কাজে হাত দিয়েছিলেন ব'লেও জানিয়েছেন তিনি। আর স্ক্রিপ্টের সেই ত্রুটির কারণে তিনি 'রাজর্ষি' আর 'বিসর্জন' দু'টোরই স্ক্রিপ্ট থেকে নিয়ে নাটকটিকে পুনর্গঠন করেছেন।
এ ত্রুটিগুলো কীরকম কী ছিল, সেটা কখনও নিজে বুঝতে পারলে কিংবা নূপুর আপার সাথে কখনও এটা নিয়ে আলাপ ক'রেও বোঝা হয়ে উঠলে ভালো, জানানোর মতো হ'লে বরং জানাবো আপনাদেরকেও। আমার পড়া ছিলো না 'বিসর্জন' কিংবা 'রাজর্ষি'। পড়া না থাকাই ভালো মনে হ'লো, যদি না স্ক্রিপ্ট নিয়ে তত্ত্ব-গবেষণা করতে যাই। নাটক তো দেখারই জিনিস, না? আপনারাও দেখতে পারেন, চাইলে।
(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০১০-০১-১০ ০৪:৩৫)
[পুনশ্চ: ধর্মীয় এবং নানা কারণে মানবেতর প্রাণী হত্যার বিষয়টিতে সংবেদী ভাবনা নিয়ে সেলিম আল দীন স্যারের স্ক্রিপ্টে ঢাকা থিয়েটারের একটি অসাধারণ নাটক এখন মঞ্চে, নাম 'ধাবমান'। একবার দেখে মনে হ'লো- কিছুদিনের মধ্যে ওটা আরো একবার দেখে তবেই আপনাদেরকে বিশদ জানাবো। এখন ফুটি। এমন চার্জই পেলাম, আর তাও আবার সেটার এমনই সদ্ব্যবহার করতে এলাম এই অঞ্চলে, যে এখন পর্যন্ত আমার সেই কাজের কিছুই হ'লো না!]
(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০১০-০১-১০ ০৪:৩৫)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন