ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] লেখাখেলা ... ০২


লেখাখেলা ... ০২

কিচিরমিচির ডাকে পাখি,
সকলেরই খোলে আঁখি
পাখির গানের জন্য,
ফেলে রেখে যাই আমি
থালায় রাখা অন্ন
... ... ... ... ... ...

ডট্ডট্-গুলো কোনোভাবেই আরো বেশি হাস্যকর বোকা বোকা পংক্তি হওয়ার কারণে কাঁচিকাটা না কিন্তু! সত্যিই এই দ্বিতীয় কচিকাঁচা কবি-তার শুধু এই পাঁচটা চরণই মাথায় আছে আমার, বাকিটা সময় খেয়ে নিয়েছে দীর্ঘ বিরতির তীব্র ক্ষুধায় 
যার যার ক্লাসে প্রথম হওয়ার পুরষ্কার হিসেবে পরপর দুই বর্ষশুরুতে বড়মামা আমাদের দু'ভাইয়েরই হাতে কিছু টুকিটাকি শিশুতোষ বই আর পড়ার উত্সাহও তুলে দেয়ার আরো সময় পরে, আমি যখন তৃতীয় শ্রেণীর শুরুর দিকে, তখন আবার মামার আরেক ছোটকাগজ বের হবে 'বিকিরণ' নামেতো, সেখানে বড়মামার ছোট দু'দু'টো ভাগ্নের লেখা না গেলে কীভাবে হয়, যেখানে আবার কিনা সেই দু'জনও বেড়ে উঠছে ক্লাসে ভালো ফলের পাশাপাশি রীতিমতো সহপাঠ্যক্রমিক পাঠাভ্যাস নিয়ে! আবার মামা দু'ঘরে দু'ভাগ্নেকে আলাদা পরীক্ষায় বসালো, সৃষ্টির মহান পরীক্ষায়অনেক সময় নিয়ে হ'লেও বেরিয়ে এসেছিলাম সে যাত্রায়ও আরেকটা মানরক্ষামূলক উত্পাদ নিয়ে, যেটার নাম খুব সম্ভবত ছিলো 'পাখি' আর প্রথম পাঁচটা পদ ছিলো উপরের ওই প্রথম শোনানো কিচিরমিচিরগুলোকটকট থেকে কিচিরমিচিরতবে আওয়াজ থেকে আওয়াজেই উড়ালজাহাজ থেকে উড়ালপংখিতবে অনেক ওপর থেকে একটু নিচে নেমেও, কোনোভাবে সেই আকাশ থেকে আর ছোটা হ'লো নাছোট্ট দু'টি হাত, ছোট্ট ছোট্ট হাঁটাকিন্তু আকাশেই চোখ, আকাশেই মন

ততোদিনে যাদুর ঘোরে পাগলপ্রায় হয়ে আম্মার এক চাচাতো নানার পাড়াতো বাসায় আমাদেরও টিভি দেখতে যাওয়াটা বন্ধ হয়েছেকারণ বাসায় এসেছে একটা ২০ ইঞ্চি সাদাকালো ন্যাশনাল টিভিকাঠের আরেক বিশেষ বাকশে বন্দি থাকে অনেক দামি অনেক যত্নের সেই যাদুর বাকশো নিজেদের বাড়িতে একটা আপন বাকশো পেয়ে, আমি সবসময় দেখতাম সেটার একেবারে দু'তিন ফুট দূরত্বে ব'সেআমার জন্য বাসার অন্যেরা ঠিকমতো দেখতে পারতো না, টিভির সামনেটা আগলে রাখি ব'লে আমাকে ডাকা হ'তো 'সাইনবোর্ড' 'লেপরে, অনেক পরে, ক্লাস সেভেনে উঠে আমারই সন্দেহ-অনুযোগ শুনে চোখের ডাক্তারের কাছে যখন নিয়ে যাওয়া হ'লো আমাকে, বাসায় ফেরাও যখন হ'লো চোখের সামনে আরো এক জোড়া চোখ নিয়ে, সে যাত্রায় ডাক্তারের কথামতে অবশ্য বোঝা গ্যালো- আমার চোখ আরো বেশ ছোটবেলা থেকেই কমজোর ছিলো আর সে-কারণেই আমি টিভি'র অতো কাছে গিয়ে ছাড়া দেখতে পেতাম নাতবু, এই বায়োলজি'র সাথে সাথে আমি এটাও জানি এবং জোর গলায় বলতে পারি মনের সাক্ষ্য নিয়ে, যে টিভি-বাকশের প্রতি আমার আগ্রহ-আকর্ষণও বিশেষ বেশিই ছিলোশুধু ফ্যাসিনেশনই না, বরং অনেক বড় আর স্থায়ী ইনস্পিরেশনও ছিলো ওটা আমার

ছোট ওই বাকশোটার ভেতর বিশেষ কোনো প্রযুক্তিকৌশলে ভৌতভাবে ঢোকার অতোবোকা ইচ্ছেটা যদিও আমার হয়নি (সেটাও হয়েছিলো আমার এক সত্যিবোকা খালাতো ভাইয়ের), ওই বাকশের মানুষগুলোর মতো ক'রেই এমন অমন কিছু কাজ করতে হবে আমার, যেন আমিও ওরকম সবার পরিচিত আর আকর্ষণের ব্যক্তি হ'তে পারি- এই ইচ্ছেটা, বরং সংকল্পটা, আমার বেশ শক্তপোক্তভাবেই হয়ে উঠেছিলো সেই পুচকেবেলাতেইএটাই আরো পরের দিনগুলোতে একটু একটু ক'রে বড় হ'তে হ'তে আরো পরিণত এমন একটা রূপ পেলো মাথায়; যে- খাওয়া, তার ফলে ত্যাগ করা, সে-কারণে আবার খাওয়া; ঘুম; বাবামা'র সুসন্তান হওয়া; দেশের সুনাগরিক হওয়া; গাড়িবাড়ির মালিক হওয়া; স্বামী, বাবা, শ্বশুর, দাদা-নানা হওয়া; আর মরহুম হওয়া ছাড়াও জীবনে অন্য আরো কিছু লক্ষ্য আর কর্ম দরকার আমারও, যেটার বা যার কিনা একটা গোষ্ঠী বা সমাজমাত্রা থাকবে আর যার ফল-কর্মপরিচয়ে আমি হবো অনেক মানুষের চেনা আর আগ্রহের কেউ

যাক, প্রসঙ্গাশ্রয়ী এই কৈশোর-ঝাঁপ থেকে আবার একটু ফিরে যাই শিশুকালের শিশুমাপের ওই একরৈখিক অল্পগল্পগুলোয়আমাদের দু'ভাইকে সাঁতার শিখাতে গিয়ে জেরবার হয়েছিলো বড়মামাতার কাজ সহজ করার একটু-ভুল চিন্তায় আব্বা একটা লাইফ জ্যাকেটও এনে দিয়েছিলেন আমাদের সেই দ্রোনাচার্য মামার হাতে; কিন্তু এই লাইফ জ্যাকেট এমনিতেই ভাসিয়ে বাঁচিয়ে রাখে ব'লে আমরা নিজের জীবন দিয়ে দেখলাম যে সাঁতার শেখার জন্য এই জিনিস জীবনেও কোনো কাজের হ'তে পারে নাবিশেষত আমি একদমই পানির গভীরে যেতেই চাইতাম না ওই জ্যাকেট থাকা সত্ত্বেও, কেমন একটা অবিশ্বাসই যেন ছিলো ওই প্রকৌশল-পোশাকটার ওপরও, মামাকে আমি বলতাম- "মামা প্লিজ, আমার অনেক দিন বেঁচে থাকার ইচ্ছা"! তো, ওই প্রশিক্ষণ-প্রয়াস বস্তুতই বাসায় ফেরার পর মামার আর আম্মার স্নেহবত্সল ধারাবাহিক হাসিতেই থেমেছিলোমামা ধৈর্য কিংবা উত্সাহ হারিয়েছিলো আমার ওই ছোট্ট প্রাণের অতো বড় জীবন-সংশয়ের আতংকে

যে-কারণে এমন পাশের এই গল্পসুতোটাও ব'লে ভেঁজে এলাম এদ্দূর, সেটা হ'লো- পানির সাঁতারের বিদ্যাব্যর্থ আমাদেরকে নিয়ে আবার ওই কাগজ-কলমের সাঁতারের জায়গাটায় একদমই হাল ছাড়তে হয়নি মামারআমাদের দু'ভাইয়ের মজা-পেয়ে-যাওয়া নাওয়ে বড়মামাও আনন্দে তুলে দিতে থাকলো পাল, ফুঁকে দিতে থাকলো হাওয়ামামার ব্যাংকের যতো মধ্যবর্তী হিসাবের কাগজপত্র যখন একসময় এসে তথ্যমূল্য হারিয়ে ফেলতো, তখন সেই একপাশে ছকবদ্ধ লেখা আর অন্যপাশে ভীষণ সম্ভাবনাময় এক শূন্যতা-সমেত সেই কাগজের তাড়াগুলো এসে জায়গা পেতো আমাদের বাসায়আর আমরা দু'ভাই সেগুলোকে ছোট নোট-প্যাডের আকারে কেটে কেটে খাতার পরে খাতা বানিয়ে, সাদাপিঠে তুমুল দামাল উত্সাহে ওইটুকু বয়সে (৩য়-৫ম শ্রেণী) বলতে গেলে প্রায় দিনপঞ্জি লিখতাম! আম্মার চর্যাবলে একদিকে যেমন 'আবৃত্তি' টাবৃত্তি ক'রে (সে এক বিষম মজার দিন ছিলো কবিতা 'আবৃত্তি', অঙ্গভঙ্গি ক'রে রীতিমতো অভিনয়ই করতে 'তো কবিতার!) পাওয়া সনদপত্র আর টিফিনবক্স-হ্যারিকেন জমা করি, অন্যদিকে আম্মার কীর্তিমান ভাইয়ের প্রশ্রয়ে-ইন্ধনে সঞ্চয় টিকিট জমাই, দেশি-বিদেশি ডাকটিকিট জমাই, এমনকি ছোট ছোট শত শত ভাব-ভাবনা জমাতে থাকি পাতার পর পাতা, দিনের পর দিন। ... ...

[চা-ভাত-রুটি কামানো আর খাওয়া সাপেক্ষে, চলবে]

(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০১০-০২-০৯ ১০:২৭)

কোন মন্তব্য নেই: