আমার লেখাই তেমন পড়ে না লোকে, তার মধ্যে আবার বলে পড়বে সেই লেখা নিয়ে লেখা! নিজের লেখালিখির গল্প মানুষ করে শরীর আর লেখনী দুই-ই যথেষ্ট বয়োজ্যেষ্ঠ হ'লে। আমি এখনও এমন কোনোকিছুই ক'রে দেখাইনি বা লিখে পড়াইনি, আরো ঠিক জায়গায় গিয়ে বললে আমি আসোলেই এমন কোনোকিছু হয়েই উঠিনি, কিলিয়ে বা পুড়িয়ে এমন কিছুই পাকাইওনি, যে আমার হয়ে ওঠার গল্প, বা আরো নির্দিষ্ট ক'রে আমার লেখার গল্প মানুষ বা পাঠকের চোখে তেমন রুচবে। হ্যাঁ, এটাও এমন কোনো তথ্য না, যা আপনার জানাবোঝা ছিলো না বা যা আমি বিশেষ জাদুকরি নৈপূণ্যে আপনাদের সামনে এইমাত্র উন্মোচন করলাম! হুম্, এই অংশটা ডিসক্লোজার না, অবশ্যই ডিসক্লেইমার।
বলতে কি, এই পুচকে হাতেই হাতের গল্প লিখতে এই সময়টাতে ইচ্ছে করছে বেশ, আতেলা মাথার ভেতরই একটা পোকা ঢুকেছে মাথার কথা বলিয়ে নেবে ব'লে। সেটা কেন, তা যদি আপনি প্রথম-দ্বিতীয় কিংবা ষষ্ঠ-সপ্তম যেকোনো ইন্দ্রিয়েরই কল্যাণে ইতিমধ্যে বুঝে গিয়ে থাকেন তো বুঝলেনই; তবে অন্য কেউ বা আপনিই যদি এখনও না বুঝে থাকেন, তো আর আকালের কালে অ্যালজাব্রা বোঝানোর মতো কষ্ট না করি বা আপনাকেও না দিই। তারচে' বরং এই সিগন্যালটা জ্ব'লে থাকতে থাকতে গল্পপথের জেব্রা ক্রসিংটা পার হই। আমার সাথে যে যে যাবেন চলুন, আসুন। আর না-গেলে, ভালো থাকবেন, পরে এক না একদিন নিশ্চয়ই আবার দেখা হয়ে যাবে তেপ্পান্ন হাজার গলির এই ছোট্ট শহরের কোথাও না কোথাও। তবে, নিজের ভালোর জন্য, রাগ না ক'রে সুস্থির মাথায় সুচিন্তিত পায়ে, সাবধানে যেয়েন।
আমি হবো পাইলট,
বিমান করবে কটকট।
আমার খেলা হ'লো শেষ,
তোমার কথা সুন্দর বেশ।
সুন্দর কথা শুনে ভাই-
ধন্যবাদ দেবে সবাই।
বিমান করবে কটকট।
আমার খেলা হ'লো শেষ,
তোমার কথা সুন্দর বেশ।
সুন্দর কথা শুনে ভাই-
ধন্যবাদ দেবে সবাই।
হ্যাঁ, শুরুটা হয়েছিলো এমনই গল্পপ্রতিম বিরল প্রতিভার এক বিকট স্ফূরণ দিয়ে! আপনি যেমন এখন এই ছড়া(!)/কবিতা(!) প'ড়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হাসছেন নিজে নিজে, হাসির ধারা প্রায় তেমনটাই ঝরেছিলো আমার বাড়ির লোকেদেরও। তবে, নিজেদের ছেলের নিজঘরবদ্ধ কাণ্ড ব'লে তাচ্ছিল্যের বদলে স্নেহ-প্রশ্রয়ের ভাগ বুঝিবা একটু বেশিই ছিলো তাদের সেই ঠোঁট গোল করা হাসির রাশিতে।
ঘটনার কাল আমার ক্লাস ওয়ান, সাল ১৯৮৪। আমার তত্কালীন নার্সারি-কেজি-হীন শহরে ক্লাস ওয়ান-ই অবশ্য শুরু করেছিলাম সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে। আর, অনুঘটকও না, বরং ঘটকই বলা উচিত, আমার বড়মামা। আমার মাতুলগোষ্ঠীর রক্তে কর্কটের নিয়মিত হানায়, আমার দেখা জ্যান্ত মানুষগুলোর মধ্যে বড়মামাই প্রথম বিদায় নেয় এই হেঁয়ালির পৃথিবী থেকে, আমার নানারও আগে। কিন্তু, আমার লেখাখেলার গল্প বলছি আর আমার বড়মামা আজকের জন্যও বেঁচে উঠে আসবে না- এমনটি কোনোভাবেই হওয়ার নয়। লালচে আলোর সেই ক্ষীণ মফস্বলে সেই সেকালেও মামা নিজের গরজে খরচে, দিনের পর দিন নিজেই গতর খেটে, বন্ধু-অনুজদেরকে উত্সাহ-সাহস-রসদের সহযোগিতায় ঠেলে খেদিয়ে, লিখিয়ে আর নিজেও লিখে লিখে, বের করতো ছোট ছোট সাহিত্য পত্রিকা; তার চ'লে যাওয়ার এতকাল পরে রাজধানীর বাজারে যার গ্ল্যামারাস নাম শুনলাম এসে 'লিট্ল ম্যাগ' ব'লে।
মামার ভীষণ আগ্রহ ছিলো আনআইডেন্টিফাইড ফ্লায়িং অবজেক্টস (ইউফো), সসার জাতীয় শব্দ আর প্রসঙ্গ-অনুসঙ্গে। তার বের করা প্রথম ছোটকাগজের নামও ছিলো 'ইউফো'। হাতের কড়ের সব হিসাবের বাইরের কথাবার্তা শুনে মামাকে পাগল মনে হ'তো মাঝেমধ্যেই, আমাদের দেখা বা প্রত্যক্ষ জানার গণ্ডি তখন আরো ভয়াবহ ছোট ছিলো ব'লেই নিশ্চয়ই। আকাশের চাঁদ-তারা-বিমান-ধূমকেতুতে হা-মুখ অবাক হয়ে, জ্বলে জ্বলে ওঠা আলো-আকাশের আসক্তিতে সেই ছোট্ট ঘাড়ে ব্যথা করতে করতে আমরা দু'ভাই বড়মামাকেই প্রশ্ন করতাম একের পর এক। এক ফুট অন্ধকারকেও বিপদ মনে করতে করতে গা-ছমছম ভয় নিয়ে তার কাছেই আমরা প্রথম শুনি ড্রাকুলা'র কথা। ইরানি সংস্কৃতির 'নিউজলেটার' আর রুশ সংস্কৃতির 'উদয়ন' তাকেই প্রথম পড়তে দেখেছি। নেত্রকোণায় বুঝিবা মামা একাই গ্রাহক ছিলো ওইসব বড়দের খাবারের, কে জানে! পরে, পাঁচ বছর বয়সেই বাবাকে হারানো তার (মামার) বড় ছেলেটা আরো একটু কম বয়স থেকেই তার নিজের বুদ্ধিতেই নিজের জীবনের লক্ষ্য ধ'রে নিয়েছিলো ট্রাক ড্রাইভার হওয়াটাকে, কারণ ট্রাকের ভেতর ইঞ্জিন আছে, সেখানে মোটরও আছে, আর এমন সব যন্ত্রকৌশল তার জানতেই হবে যেকোনো মূল্যে। এখন অবশ্য সেই ছেলে ক্যাডেট কলেজে পড়ছে, আর চিন্তা করছে পড়া শেষে অবশ্যই এয়ারফোর্সে ঢুকবে, কমিশনড পাইলট-ই হবে।
পাইলট হওয়া আমার হয়নি। কিন্তু, ওই যে বলছিলাম সেই ১৯৮৪ সালের গল্প, সেই "আমি হবো পাইলট, বিমান করবে কটকট"টা আমার হয়েছিলো সেই মামার কারণেই। আমার আম্মা নাকি ক্লাস ফোর-এ পড়া অবস্থায় কোনো ব্যাকরণ না শুনেই নিজে হারমোনিয়াম টিপে টিপে গানের সুর তুলে ফেলতেন! এমনকি, ক্লাস ফাইভে থাকতে নাকি একটা 'উপন্যাস'এর পাণ্ডুলিপিও লিখে ফেলেছিলেন! এ গল্প শুনেছি আমরা একটু ক'রে বড় হ'তে হ'তে আম্মার নিজেরই লজ্জারাঙা মুখের বয়ানে, তবে নানাভাইয়ের নগদ সাক্ষাত সত্যায়ন-সহ। নানাভাইও কথায় কথায় কাঁচাপাকা ছড়া কাটতেন অনেক বেলাই অবলীলায়। অবশ্য, নানাভাই কিংবা আম্মা ওইসব পোকা আগে ঢোকাননি আমাদের সেই ছোটবেলার পড়ার মাথায়।
ঢুকে গিয়েছিলো বড়মামা, নিজেই পোকা হয়ে। মামা আমাদের দু'ভাইকে তার শিশু-উপযোগী লেখা কিছু তখনই প'ড়ে শোনাতো অল্পবিস্তর। আমরা মজা পেতাম, তার অন্যান্য আরো বিষয়ের মতো এই লেখালিখির বিষয়েও। তো, একদিন উল্টো আমাকেই ধরলো মামা। আমি তো বোকা হয়ে গেলাম, লজ্জায় পুরো কাঁই হয়ে গেলাম। মামা খুব ক'রে বললো আমাকে, বারবার লোভ দেখিয়ে বুঝালো- "তোমার বুদ্ধি আছে, তুমি পারবা, দ্যাখো তো, এই নাও কাগজ-কলম, নিজের মতো ক'রে একটা কিছু লেখো, যা তোমার মনে আসে ..."। হ্যাঁ, আমার মনে তখনকার সেই সত্যি ইচ্ছেটাই এসেছিলো, যেটা কিছুক্ষণের চেষ্টায় অমন সরল বিশ্বাসে সরলতর শব্দপ্রয়োগে সরলতম বোকামিতে সেদিন সেই কাগজে নামিয়েই ছেড়েছিলাম। মনে আছে এখনও- 'কটকট' পর্যন্ত ওই প্রথম দু'লাইন আরামে মিলে চ'লে এসেছিলো মনের ইচ্ছে থেকেই, স্বপ্ন-চিন্তার স্বতস্ফূর্ত ভাষারূপ হিসেবেই। কিন্তু, ওইটুকুতেই ছেড়ে দেয়াটা নিজের কাছেই একটা লজ্জাজনক পরাজয় মনে হচ্ছিলো, তাই কিছুক্ষণের কষ্টকল্পনায়, কাঁচাহাতেও দর্জিগিরি ভাবনার ছাপ ফুটিয়ে কোনোমতে গাছে-মাছে মিলিয়ে নিয়েছিলাম সেই বিখ্যাত বিশেষ প্রথম কবি-তা'র শেষ চারটি পা-ও। তো, কাজের মধ্যে কাজ হ'লো- সেই থেকে সেই 'কটকট' আর আমার থামলো না। ...
[তাই, এই পোস্ট-ও এখানেই থামছে না। অন্তত আরো কয়েকটা পোস্ট সিরিজ আকারে চলবে।]
(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০১০-০২-০৩ ১০:০৪)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন