ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] প্রতিরাতে আমিও হন্তারক!

বেঘোর এই ব্যাচেলর জীবনে যে প্রতিরাতে মশারির ভিতরে ঢুকেও ঘুমের আগে কারো সাথে কিংবা কোনোকিছুর পিছনে এমন গলদঘর্ম গতর খাটাতে হবে- সেটা আগে ভাবিনি কোনোদিন। রীতিমতো বিনা পারিশ্রমিকে কায়িক পরিশ্রম, তা-ও আবার নাইট শিফ্ট!

বাতাসের প্রধান উপাদানের তত্ত্বে একটা পরিবর্তন এখনও পদার্থবিদ্যায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবে তার তথ্য এই এখনই আমার কাছেই পাবেন। সেটা হ’লো-
ভৌতপ্রাকৃতিক বিবর্তনে বর্তমানে অন্তত বাংলাদেশে হ’লেও, কিংবা বাংলাদেশের মধ্যে নিদেনপক্ষে আমাদের মতো নিচুতলার মানুষের আবাসিক এলাকাগুলোতে, বাতাসের মূল উপাদান ৩টি হয়ে গ্যাছে- অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর মশা। হ্যাঁ, ঠিক এটাই লিখতে চেয়েছি আমি- সাধারণ বা পদার্থবিজ্ঞানের কোনো ক্লাস-পাঠ্যবইয়ের ভৌতিক মুদ্রণপ্রমাদ নয় এটা।

নিচুতলার মানুষ হয়েও আমার বসবাস অবশ্য একটা নিচুতলীয় বাসারই ছয়তলায়। বলা উচিত পাঁচতলার ছাদে! আমার একটা ছোট্ট মিষ্টি বন্ধুনি কিছুদিন আগে ফার্মগেট থেকে আমাদের রামপুরায় চ’লে এসেছে, এখন থেকে বোন-দুলাভাইয়ের সাথে থাকবে ব’লে। সে অসহায় সুরে নির্দোষ কৌতূহল জানিয়েছে আমার কাছে- “আচ্ছা, বলো কী কাণ্ড! আমাদের এই পাঁচতলা পর্যন্ত মশাগুলো উঠে আসে কেমন ক’রে!" আমি নিজেও ভাবতে ভাবতে বৈজ্ঞানিক ভঙ্গিতে ওকে বলি- “আরে বোকা, মশার কি আর নিচের ডোবা-বিল থেকে উপরে উঠে আসতে হয়? পাঁচ-ছয়তলায় উঠতে ওদের কি আর সিঁড়ির দরকার হয়? বিশতলার ওপরও মশা থাকতে পারে। কারণ ছয়তলার মশার জন্ম আদতে ছয়তলায়ই হয়।” বলি, আর ফোনে ওর সাথে সেই জ্ঞানের কথা বলতে বলতেই নিজেই বোকাই হ’তে থাকি উত্তরোত্তর, তখনও আমারই হাতে-পায়ে পেটে-পিঠে সারাগায়ে মশকরা ক’রে ঘুরে বেড়ানো মশককুলের দুর্দমনীয় জনসংখ্যা আর সেই সংখ্যার অসহনীয় আস্ফালন দেখে!

নগরপিতা তো পিতার পবিত্র দায়িত্বে মশাদেরও জন্ম দিয়েই দিব্যি আছেন বহাল। তার সেই মশকসন্তানেরা আমার ঘুমের আরাম কিংবা ঘরের কাজকাম কীভাবে হারাম ক’রে চলেছে প্রতিনিয়ত, তাতে তো আর তার কিছু এসে যাবে না। দিন গড়াতে থাকে, আর কোনো প্রতিকার-পদক্ষেপ-হস্তক্ষেপ ছাড়াই ব্যক্তির সকল মৌলিক অধিকার স্বাধীন এবং সম্পূর্ণরূপে ভোগ ক’রে মশাদের সংখ্যা আর পরাক্রম আরো বেড়েই যেতে থাকে। উত্তরোত্তর আরো ঐশ্বর্যময় আরো আশীর্বাদময় হয়ে ওঠে বন্ধু প্রকৃতি!

মশার কয়েল বা অ্যারোসল স্প্রে আদতে মশা মারতে কাজে লাগুক আর না-ই লাগুক, আমাকে কম আহত করেনি এযাবতের জীবনে! যেই বাসস্থানেই থাকি, যেই অবস্থায়ই থাকি, মশার পরিমাণ যতোদিন পর্যন্ত একটুও মেনে নিতে পারার মতো ছিল, মানে এভাবে ওরা বাতাসের উপাদান হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত এই নিরীহ প্রাণী আমি, কয়েল-অ্যারোসলের বিষবায়ুর চেয়ে বরং তুলনায়-কম-ক্ষতিকর জ্ঞান ক’রে সহ্য ক’রে গ্যাছি মশার টুকটাক খামচি-কামড় আর গুনগুন জ্বালাতনকেই। আর, শোয়ার সময় সেই ছোট্টটি থেকেই বিছানায় মশারি খাটিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আমি খাঁটি আন্তরিকই ছিলাম। তার ওপর আবার কলেজামলে জুওলজি'র রসিক পণ্ডিত গাজী আজমল স্যার ‘তেলাপোকার খাদ্য’ পড়াতে গিয়ে শুরুতেই বলেছিলেন- “তেলাপোকা কী খায়, সেটা বলার চেয়ে অনেক সহজ আর সুবিধাজনক হয় এটা বলা, যে তেলাপোকা কী খায় না!” শুধু তাই না, তার পরপরই নিজের বাস্তব জীবনের একটা উদাহরণ বা অভিজ্ঞতা হিসেবে স্যার নিশ্চয়ই প্রতিবছরই ছাত্রদেরকে ব’লে যেতেন তাঁর ভিকারুন্নিসা আমলের এক ছাত্রীর একরাতে অতর্কিতে বিনাদোষে তেলাপোকার প্রাকৃতিক প্রতিভার অভিশাপে নিজের একপাটি ভুরু সমূলে হারানোর অপার ব্যথার কথা। তারপর থেকে কখনও সখনও মশার প্রাদুর্ভাব কম পেলেও অন্তত সর্বভূক প্রাণী তেলাপোকার ভোজ হয়ে যাওয়া থেকে জীবনের প্রায় প্রতিরাতেই মশারি খাটানোর কষ্টকর সক্রিয় প্রয়াসে আমি রক্ষা করেছি আমার শরীরের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-উপাঙ্গকে। নিতান্ত গরম কিংবা জনসংখ্যার বাড়াবাড়িতে কদাচ কখনও মশারির নিচে ঘুমানো প্রায় অসম্ভব হ’লেই কেবল কয়েল কিংবা অ্যারোসলকে একটু ভদ্রভাবে সহ্য করেছি ঘুমের এবং নিজের আর সহঘুমাদের খাতিরে।

কিন্তু, মশারি না হয় খাটালাম ঘুমের বেলায়! ঘরে একটু লেখালেখি, মুভি দেখাদেখি, রান্নাবান্না, খাওয়াখাওয়ি, প্রকৃতির ডাকে আওয়াজ দেয়াদেয়ির মতো এত এত কাজকর্মের সবই তো আর মশারির আশ্রয়ের ভিতরে করা সম্ভব না! কিন্তু বাসায় ঢুকলেই মশা, মশারি কিংবা অতি-বৈজ্ঞানিক বায়ুশূন্য কোনো ইশ-যদি-থাকতো চেম্বার ছাড়া আর যে কোনো অপশনই দেখি না! আর, মশার কয়েল আর অ্যারোসলের বিরুদ্ধেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধ’রে লড়তে লড়তে এই সময়ে মশকপ্রজাতি তো অনেকটাই ফিট হয়ে গিয়ে সারভাইভ ক’রে ফেলছেই বলা যায়। তাই ওইসব পুরোনো অস্ত্র জ্বালিয়ে বা ছিটিয়েও নিচুতলা-ছয়তলার ভেজাল হোমোসেপিয়ান্স আমি নিজেকেই সারভাইভ্যাল-উপযোগী ফিট হিসেবে দেখতে পাচ্ছি না আর। তাই, জীবনের শেষ চিকিত্সা হিসেবে চেষ্টা করার জন্য সেদিন কিনে ফেললাম মাত্রকিছুকাল আগে আবিষ্কৃত একটা মশামারোন্তি ইলেকট্রিক র‌্যাকেট!

অ্যান্ড ইয়া, [বিজ্ঞাপন্য ভাষায় বলি-], নাওঅ্যাডে’জ আই অ্যাম লিডিং আ ম্যাজিক্যালি বেটার লাইফ অ্যাট হোম!

‘মাল’টা যথার্থই এবং যথেষ্টই কাজের। পটপট স্যাটাস্যাট শব্দে মশা মরতে থাকে। অনেক সময় লেগে যায় শত্রুপক্ষে সংখ্যাধিক্যের জন্য। তবু, শেষ করা যায় অনেক সময় নিয়ে হ’লেও। মশারিটা খাটিয়েও ভিতরে নিয়ে একবার কোনাকাঞ্চিগুলানে এটা একবার ঘুরিয়ে আনলে মোটামুটি ঘণ্টাকয়েকের রাতঘুমটা আরাম হয়।

বেআরামের জায়গাটা হ’লো- মশা তো মেরে এসেছি সারাজীবনই কমবেশি, কিন্তু এবারের প্রক্রিয়াটা আমাকে আরামের ফাঁকফোঁকরে অন্যরকম একটা অস্বস্তিও দিচ্ছে খুব গভীর ক’রে! ইলেকট্রিক উপায়ের এই প্রাণিহত্যায় যে দৃশ্য আর শব্দ সৃষ্টি হয়, তার জন্য নিজেকে আগের চেয়ে অনেক বেশি অবিবেচক হৃদয়হীন নিষ্ঠুর লাগে। যেভাবে পোড়া গন্ধ ওঠে মশার ওই ছোট্ট শরীরগুলোর, যেভাবে সারি বেঁধে চোখের সামনে পড়তে থাকে মশাদের শব, এত হিংস্র নৃশংস লাগে নিজেকে! উত্তর পাই না নিজের এই দিকহীন বিদিশার। রাতের বেলায় ঘুম-প্রস্তুতির কাছাকাছি সময়ে ইদানীং আশপাশের অন্যান্য বাসা থেকেও ভেসে আসে এই অসম যুদ্ধ আর গণহত্যার শব্দ। হত্যা করতে করতেই আজও কেমন আউলে আউলে যাই আমি, একদম সত্যি কথা, কসম! আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় কাজটার ঠিক এই রূপটার জন্যই হয়তো এই অনুভূতি বা উপলব্ধিটা এতদিনে এভাবে এরকম মাত্রায় হয়ে উঠলো, যে- আমিও খুনী, আমিও নিজের সুখশান্তির জন্য অন্যকে হত্যা করি! ছোট প্রাণীর বাস্তুসংস্থানীয় ভূমিকার (আমাদের কাছে যেটা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ!) কারণে সেই বাস্তুসংস্থানের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ হিসেবে এই আমিও একজন সিরিয়াল কিলার!

প্রাণিহত্যা মহাপাপ! বুদ্ধিজম মনে আসে। আগের বিভিন্ন সময়ের এলোমেলো চিন্তাগুলো আবার ম্যালা ক’রে মনে ভাসে-

খাওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত আমরা গরু-মুরগি-মাছ হত্যা করছি; পোশাকের জন্য কাপড়-সুতা উত্পাদনে ভেড়ার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষাও আজকাল ব্যবসার হিসেবে পোষায় না, পায়ের নিচে ফেলে কিংবা হাতুড়ির আঘাতে হত্যা ক’রে পশম-চামড়া তোলা হয় ব'লে এই তো ক’দিন আগেই ভিডিও বিবরণ-প্রমাণ দেখলাম একটা! অতো দূরেই বা যাই কেন?! প্রাণী না খেয়ে যদি সবজিভোজীও হ’তে যাই, তাতেই বা কী! গাছেরও যে প্রাণ আছে! কতো নিগূঢ় তত্ত্ব আর কতো নিষ্ঠুর সত্য যে মাথার চারপাশে ভনভন করে মশার চেয়েও বহুগুণ বেশি তেজে! হায় রে বাস্তু! হায় রে সংস্থান! হায় রে শান্তি! হায় রে জীবন! হায় রে দুনিয়া! ...

শেষ হয় না। ক্লান্ত হই। ক্ষান্তি দিই।

অগত্যা অতএব প্রতিরাতে গণহত্যা ক'রে যাই, নইলে যে শ্রেয়তর জীবন আয়োজনে শান্তি আসবে না!

(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০০৯-০৪-০৯ ২০:৫০)

কোন মন্তব্য নেই: