ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!

স্বপ্নের মতোই হুট ক’রে ঘটলো ব্যাপারটা, একটা ঘোট-পাকানো অন্ধকারের গভীরে। না কি দুঃস্বপ্ন! কিংবা, দুঃস্বপ্নই হয়তো ঠিকঠাক স্বপ্ন, আর সুস্বপ্ন বা সুখস্বপ্ন হিসেবে যা দেখি বা ভাবি, সেগুলোর সবই বুঝি কেবল স্বপ্নদোষ!

যেই দেশে আমাদের মতো কিছু বোকা মানুষ নূন-আনতে-পানতা-ফুরায় না হয়েও অপব্যয়ীও নই, হিসেব ক’ষে চলি, উপরন্তু কষ্টে টাকা রোজগার ক’রেও দেশ-রোজগারী বীর মুক্তিযোদ্ধার জন্য যার যার সামর্থ্যমতো যুদ্ধে লড়ি, ল’ড়ে মরি, সেই দেশেরই সত্যিকারের সোনার ছেলেরা
তাদের চিকন মাথা এমন জায়গায়ই খাটায়, যেখানে মওকামতো খ্যাপ্ পেলে ৫ মিনিটের শ্রমেই (ফাঁপর নিতে ন্যূনতম যতোটুকু যান্ত্রিক শক্তি খরচ হয় আর কি পদার্থবিজ্ঞানের হিসেবে!) ২৯,০০০ টাকা রোজগার করা যায়! আর, বেশির কোনো সীমা তো নাই-ই।

এর আগে ২০০৪ সালের শেষের দিকে শান্তিনগর পুলিশফাঁড়ির সামনে (!) প্রথমবারের মতো ছিনতাই হয়েছিল আমার। সেই বিস্ময় ভুলে গেলে পরে আবারও ২০০৬-এর জানুয়ারি-তে আরো একবার ব্যবস্থা হ’লো আমার থ খেয়ে ব’সে থাকবার। সেবার মাদারটেকে সেই সেকেন্ড-টেক ছিনতাইয়ে অর্থ আর ফোন হারিয়ে অর্থহীন জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরে দেশ-পৃথিবী-যুবসমাজ-আমি-জীবন-জন্ম-শুভ-অশুভ-ন্যায়-অন্যায়-ঈশ্বর(!) নিয়ে একলা ঘরে সারারাতই প্রলাপ বকেছিলাম মনে আছে। মানসিক ভারসাম্য প্রায় পুরোটাই হারাতে বসেছিলাম বলা চলে। পরদিন হঠাত্ চেতনে ফিরে নিজেকে জীবিত এমনকি সুস্থ আবিষ্কার ক’রেই বরং অবাক হয়েছিলাম খুব। বোনাস প্রকৃতিস্থ এই জীবনে পণও ক’রে ফেলেছিলাম- এই পোড়াদেশে আমি আর মোবাইল-বিলাসিতা করবোই না। তখনকার বাসা-সদস্য বাবা আর ভাইয়ের উদ্বেগ-উপচিকির্ষায় অবশ্য পণ ভাঙতে হ’লো তাড়াতাড়িই, রোজগেরে আমিও জরুরি ভিত্তিতে আবার পেলাম বাবার কিনে দেয়া বাধ্যতামূলক ফোনসেট। ২০০৭-এর শেষভাগে ঘ’টে বসলো আরেক উচ্চাভিলাষী দুর্ঘটনা! সরকারী আর ইলেকট্রনিক দুই গ্যাজেটেই সমান অনাগ্রহী আমিই কিনা খুব ভালো আর এমপ্যাথেটিক একজন এমএমএস-দয়ালু বন্ধুর যথার্থ প্ররোচণায়-প্রেরণায় নিজের অর্থে কিনে বসলাম নেট-এমএমএস উপযোগী একটা ‘ভালো’ সেট! সেই ফোনে স্থির ছবি যেমন থাকে, চলচ্ছবিও থাকে, থাকে গান, থাকতে থাকে অমোচনীয় কিছু এসএমএস-এমএমএস-ও, দিনের পর দিন। ’০৮-এর মাঝামাঝি আবার কয়েকটা আউটগোয়িংয়ের বিশেষ সুবিধার আশায় সাশ্রয়ী একটা সিম-কার্তুজ লোড ক’রে রাখার মতো আরেকটা লো-কস্ট বেসিক সেটও কিনি, সেই ‘ভালো’ সেটের কাছে যেটা ২ নম্বরই হয়ে ছিল এই সবটা সময়। দিনের পর দিন যেহেতু গ্যালো, সেখানেও জ’মে গ্যালো কথাভূক আমার আরো কিছু সময়-স্মৃতি আর আবেগেরও দিনলিপি। দুই পকেটে দুই ফোন রেখে চলাচল করি, প্রথম কিছুকাল লজ্জা লজ্জা হ’লেও অভ্যাসও হয়ে যায় দ্রুতই। তার পরে বরং একটা সেট হঠাত্ কখনও কোনো কারণে সাথে না থাকলেই পকেট খালি লাগতো, রীতিমতো গরিব মনে হ’তো নিজেকে। তো, বহুকাল পরে আজ রাতে ঘরে ফিরলাম নির্ঝঞ্ঝাট- চলতে পথে কোনো পকেটেই বারবার হাত ঠেঁকিয়ে দেখতে হয়নি- ফোন ঠিক আছে কি না, বা কোনো কলের ভাইব্রেশনই হচ্ছে কি না আবার! কারণ, সেই দু’টোই মুঠোফোনের গুরুদায়িত্ব আজ সন্ধ্যায় নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে তিন-তিনজন মেধাবী দয়াবী ছিনতাইকারী!

সচল ব্লগার জিফরান খালেদের বাবা - বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাই প্রকৃত অর্থে আমাদেরও বাবা - এস এম খালেদ কর্কটাক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁকে সেই রোগের কাছে আত্নসমর্পণ করতে দেবে না ব’লে দাঁতকপাটি গোঁ ধরেছে এদেশের দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রজন্মের বেশক'জন দুরন্ত খ্যাপাটে ছেলেমেয়ে। তারা সবাই সবাইকে সঙ্গ-সাহস-ধাক্কা-চাক্কা দিচ্ছে, সবাই মিলে এগিয়ে যাচ্ছে জীবনের মহত্তম রণে। পূর্ণ সচল না হয়েও অতিথি মর্যাদার ব্লগাররাও মেহমানের ভদ্রতায় চুপচাপ ব’সে থাকেনি এখানে। মধ্যবিত্ত কুমার এই আমিও সেখানে ছোট্ট হ’লেও একটা ঢিল ছুঁড়বো ব’লে ঠিক করলাম। সেই ঢিল-বাবদ ৫ হাজার টাকা ব্যাকপকেটে নিয়ে ঘুরছিলাম আর ছোট ছোট বুকপকেটের বড় বড় আশাগুলো ভাগাভাগি করছিলাম সবার সাথে। কল্পনায় কয়েক মাস পরই সুস্থ হাসিমুখ শ্রদ্ধেয় খালেদ চাচা, আর পরিকল্পনায়- কয়েকদিনের মধ্যেই কোনো এক সুবিধা-সন্ধ্যায় তারেক কিংবা নজরুল ভাইয়ের হাতে পাচার ক’রে দেবো পকেটে পালতে থাকা সেই ছোট্ট ঢিলটি। উত্তরার দিকে যাওয়াও হচ্ছিলো না দিনের বেলা, তাই ব্যাংকে জমা দেয়ার চেয়ে মনে হচ্ছিলো- তাদের কারো হাতে দিয়ে দিলে পরে একসাথে নিশ্চয়ই কোনো কাজে লাগবে সেই নগদ। আজ সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় তারেককে ফোন দিলামও একবার, যেন তারেক ভার্সিটি অঞ্চলের কাছাকাছি থেকে থাকলে তার সাথে দেখা ক’রে টাকাটা দিয়ে দিতে পারি। তারেক ধরেনি সেই অচেনা নম্বর, ব্যস্তও ছিল হয়তোবা। সেই টাকাটার দায়িত্বও তখন থেকে আর দেড়ঘণ্টার মধ্যেই নিয়ে নিয়েছে একই সেই মহান তিন বীরপুরুষ।

টাকাপয়সা বানের মতো বইছিল না এমনিতেই। বওয়ার কথাও ছিলো না কখনও। জীবনের যুদ্ধের জন্য পকেটে একটা ঢিল নিয়ে ঘুরতে ঘুরতেই গতকাল হঠাত্ই শোনা হ’লো কলজের-টুকরো ছোট বোনের একটা অসুস্থতার কথা, যেটা ঢাকায় এনে পরীক্ষা করানো দরকার, আর যে পরীক্ষার ফল হঠাত্ গুরুতর খারাপও হ’তে পারে। না-ও-তো-হ’তে-পারে নামক আশায় যথারীতি বুক বেঁধেই একদিকে বাবা-মায়ের সাথে জরুরি আলোচনায় সামনের সপ্তাহেই মা-বোনের ঢাকায় আসা এবং প্যাথোলজিক্যাল যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব সাব্যস্ত করি, আর অন্যদিকে পকেটের ওজন মাপতে শুরু করি ব্যাংকের অংকের সাথে হাতেরও আন্দাজে। তার ওপর, সেই বোনেরই ঢাকায় বেসরকারী-অনার্স লেখাপড়ার ব্যাপার শুরু হচ্ছে আশা করি সামনের মাসেই- সেখানেও আব্বাকে বহু আগেই সাহস দিয়ে রেখেছি- “ওর পড়ার খরচ মূলত আমিই সামলে ফেলতে পারবো দে’খেন”। অংকটাকে আরো বেশি জটিল করেছে সাধারণ নির্বচনের যে অংশটি, সেটি হ’লো- পড়ালেখার জন্যই বোনের থাকার সুবিধার্থে এবার আমিও যাচ্ছি একলা-একঘরে-বসবাস থেকে আবার হাফ-ফ্যামিলির মধ্যে- বাবা আর বোনকে নিয়ে থাকবো, বাসা ঠিক হয়ে রয়েছে উত্তরায়। আজ সন্ধ্যায় সেই বাসায়ও দু’মাসের অ্যাডভান্স করতে হবে, নইলে বাসার বায়না হচ্ছে না, যেকোনো মুহূর্তে এসে সেটা ছিনিয়ে নিতে পারে আর যেকোনো কেউ! সেক্ষেত্রেও সম্প্রতি-সাহসী-হওয়া আমারই আগে থেকে ব’লে-রাখা অভয়বাণীর আলোকে আপাতত হ’লেও সেই অগ্রিমের দায়িত্বটিও আমার। সেই টাকাও এটিএম-এ ভাঙিয়ে আব্বাকে দিলাম যখন বিকেলে, তখন আমার মাসের সামনের দিনগুলো চলার জন্য বাড়তি আরো তুলে ফেললাম ছয় হাজার টাকা। সেটাও রইলো একই সেই ওয়ালেটে। বাসায় এসে সেটা নিরাপদে রেখে দিতাম বাংলা উচ্চারণ অভিধানের ভিতরে। তবে, এখন আর ভাবনা নেই। এই ছয় হাজার টাকাও সেই তিনটে সোনার ছেলের সামনের কিছুদিন ভালো-চলায় ভূমিকা রাখতে পারলো- ভাবতে ভালোই লাগছে।

[০৫ মে ২০০৯ দিবাগত রাত
অন্যপুর]



২.

দ্বিতীয় ছিনতাইয়ের পর আমি যেই অবস্থানে ছিলাম সবকিছুর ব্যাপারে, সেটা এক সময়ে ধারণাগতভাবে এমন পরিণতিই পেলো, যে- এই দেশে বেঁচে থেকেই টেনশন, 'সাফা কিরকিরা' হয়ে গেলে বরং তার চেয়ে ভালো, তাই এরপর আবার কখনও এরকম ছিনতাইয়ের মুখোমুখি হ’লে সহজে ছেড়ে দেবো না, প্রতিরোধ করবো সাধ্যমতো। ওই দু’টো অভিজ্ঞতা থেকে নির্দিষ্ট যে শিক্ষা নেয়া গ্যাছে, তার আলোকে যতোটা পারা যায় সতর্ক সচেতনও আমি ছিলামই সব সময়। এর মধ্যে আবার ভুলে হোক যা-ই হোক, জীবন সম্পর্কে একটু সেকেন্ড-ট্রাই নিচ্ছিলাম মাস কয় আগে থেকে, পোড়াদেশের পোড়াজনমেও ভুল ক’রেই আবার ‘মাল’এর সাথে সাথে ‘জান’ও মূল্যবান হয়ে উঠলো আমার! হায়রে ‘মাল’, আর হায়রে ‘জান’! দু’জনকে একসাথে নিয়ে ঘর করার শান্তি- না, কপালে নাই। ‘মাল’এর ওপর দিয়ে গেলেই শুনেছি খুশি হয়ে স্রষ্টার শোকর করতে হয় এই কারণে যে ‘জান’টা তো ঠিকঠাক রেখে গ্যাছে! আমার বাবার সাথে সকালে যখন কথা হ’লো, তখন তার শেষ বাক্যও ছিল- “যাক, আরো কিছু যে হয় নাই, সব আল্লাহ্'র ইচ্ছা”! তো, হ্যাঁ, আল্লাহ্ জাতীয় কারো এই জাতীয় ইচ্ছাগুলোর জন্যও আজকাল প্রস্তুতই থাকি একভাবে সব সময়। সিএনজি স্কুটার বা মিশুক নামক অমানুষিক খাঁচাগুলোয় বসলেও একা আমিও মাঝখানে না ব’সে বাঁপাশ ঘেঁষে বসি, যেন খুব সহজে পাশ থেকে চাপিয়ে দু’দিক থেকে আমাকে অবরুদ্ধ ক’রে না ফেলতে পারে কোনো দুষ্ক্রীতিসন্তান! কিন্তু ঘটনা এমন উপায়েই ঘটে, যে সেই প্রস্তুতি কখনও যথেষ্ট হয় না, হয়ওনি। হ্যাঁ, কাল বিকেলেও একবার আমার মনে হয়েছিল অন্য বিভিন্ন সময়ের মতো, যে আমি যদি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি আরেকবার, তাহ’লে কী হবে! এমনকি রিকশার পাশে এসে ছিনতাইকারীরা দাঁড়ালে আমি কীভাবে কী রোধ করবো চেষ্টা করবো ব’লে ভেবেছিলাম সেগুলোও আবার চোখে ভেসে উঠেছিল তখন। না, পরিহাসবোধে তখনও হাসি পায়নি আমার। হাসি পেয়েছে পরে, রাতে যখন আবার পুরো ব্যাপারটার একটা রিক্যাপ হচ্ছিল মাথায়। সন্ধ্যায়ও অফিস থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ আগে কাকের তালে এমনকি এটাও ভেবেছি- এই যে এমন ক’রে আজকাল প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় অফিসপাড়া শেষে নাটকপাড়ায় যাচ্ছি সিএনজি ক’রে, এটা ঠিক হচ্ছে না, নিরাপদ হচ্ছে না- একটু আগেভাগে বেরিয়ে, একটু ঝামেলা ক’রে হ’লেও বাসে যেতে পারা ভালো। না, শেষে অতো সময় রেখে বের হওয়াও হয়নি যথারীতি, বাসে যাওয়াও হয়নি।

অফিস থেকে নামলাম ৮টা ২০-এ। ৯টার মধ্যে শিল্পকলায় পৌঁছাতে চাই। বসের সাথে অফিসের নিচের বর্ধিত মিটিং (স্ট্যান্ডিং) থেকেও ছুটি নিয়ে নিলাম কয়েক মিনিটের মধ্যেই, কারণ আমাকে ‘দূর ইশারায়’ হাতছানি দিয়ে ডাকছিল সোনার ছেলেরা। এটা খুব কম ঘটলেও আগে কখনও যে ঘটেনি তা নয়, সিএনজি-ওয়ালা ১০০-৮০’র দাবি না ক’রে যথেষ্ট ভদ্রলোকের মতো বললো- “দশ ট্যাকা বাড়ায়া দিয়েন”। সময়মতো যেতে পারবো’র সাথে সাথে আমি যথারীতি খুশি হয়ে উঠলাম এই কারণেও যে- এখনও কিছু ভদ্র সিএনজি-চালক আছে, যারা এক ভাড়ায় দুই ভাড়ার টাকা উশুল করতে না চেয়ে বরং ন্যূনতম ন্যায্য থাকার চেষ্টা করে। তেজগাঁ’র দিকে গিয়ে ওই অন্ধকার প্রধান সড়কেই স্কুটারের স্টার্ট থেমে যায়। একটু পরেই বুঝতে পেরেছি, আসোলে ইচ্ছে ক’রেই স্টার্ট থামিয়ে দেয় আমার সেই ভদ্র সিএনজি-চালক, হঠাত্ এক সন্ধ্যায় আমার অবস্থা-অবস্থানেরও যে চালক হয়ে গিয়েছিল সে! স্টার্ট নেয়ার একটা মিথ্যা চেষ্টাও ঠিকঠাক শেষ হয়নি, তার মধ্যেই দু’পাশ থেকে তিনজন এসে ঢুকে গ্যালো আর কিচ্ছুটিও বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে। বিশ্রী গালিগালাজ করতে করতে মুখ-গলা-হাত-হাঁটু সবই চেপে ধরতে পারলো তারা, চাপিয়ে দিলো আমায় জীবনের এই বিশ্রী নর্দমার উপরে আরো একবার। মাঝখানের-জন বসলো আমার কোলের উপরে, আর আমার হাতদু'টোও নিয়ে বন্দি করলো তার হাতের বন্ধনিতে- যেন ছেলেখেলার কাঠের টাট্টুঘোড়া আমি, বড় অধিকার নিয়ে তাতে চ’ড়ে বসেছে সে তার আনন্দের উপলক্ষে। না, ট্রমা তেমন একটা বেশি হয়নি এবার। মাথাও যথেষ্ট ঠাণ্ডা ছিল কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর থেকেই। এতটাই ঠাণ্ডা এবং সচেতন, যে জীবন-সম্পর্কিত আমার ঈষত্-পরিবর্তিত ভাবনা এবং নির্দিষ্ট ক’রে এই ঘটনাটা এবার যেভাবে ঘটছিল সেই মুহূর্তে, তাতে খুব বোঝাই যাচ্ছিল আবার, যে ঝামেলা ক’রে আসোলে দূর-অদূর ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়ে যাওয়া বৈ লাভ কিছু নেই। আগের দু’বারের চেয়ে এবার এত বেশি সফিস্টিকেটেড আর কার্যকরভাবেই হয়েছে ব্যাপারটা, যে চারটে মানুষ আর চার-চাকা-চলা একটা বড় যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই আমার মতো নিম্নস্তরের স্বল্পবুদ্ধির প্রাণীর ঝামেলা করার সামর্থ্যের কথা বাদই দিই, আসোলেই সুযোগও ছিল না কোনো। ওরা ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই স্কুটার ঠিকই স্টার্ট নিলো আবার, একটু পরেই একটা গলির ভেতরও ঢুকে গ্যালো। আশপাশ থেকে অন্য কারো বোঝা তেমন সম্ভব ছিল না ভিতরে কী হচ্ছে, এবং সেটা বুঝলেও নিশ্চয়ই কেউ কিছু করতোও না আসোলে। আগের বার মাদারটেকের রোমাঞ্চকর ঘটনাটাও রাস্তাভর্তি মানুষের সামনেই ঘটেছিল পূর্ণ-প্রকাশ্য নিয়ন-টাংস্টেন আলোয়। পেশীবহুল না হ’লেও পশুর শক্তিতে দুরূহ তিনটে ছেলের সাথে ভিতরেও কিছু করতে পারলাম না বা চেষ্টাও করলাম না আমিও।

অ্যান্ড দ্য মিশন ওয়াজ কমপ্লিটলি সাকসেসফুল! মুখ চেপে ধ’রেই প্রশ্ন ক’রে উত্তর শোনার জন্য একটু মুখটা ছেড়ে আবার ধরে। আমি যখন অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া কিংবা গুলি-চাকু-মলম মারা (যেগুলোর আলাপ-সালাপ করছিলই তারা) জাতীয় আরো বড় কোনো ঝামেলা না করতে বলতে যাই, তখনই আবার মুখ-চেপে-ধরাটা ওরা নিশ্চিত করছিল তত্ক্ষণাত্। আর তিনমুখের গালিগালাজ হুমকি-ধামকি যেমন চলতে থাকে নিরন্তর, তেমনি দু’দিক থেকে দু’জনের তিনটি হাত আমার জিন্সের চারটি পকেটই পরিষ্কার করতে থাকে স্থির লক্ষ্যে। ওয়ালেটের ভিতরের অর্থকড়ি সাফা ক’রে আমার অনুরোধমতে কাগজপত্র আর তিনশ’ টাকা (ওর কথামতে। পরে আমি উদ্ধার পেয়ে ওয়ালেট খুলে দেখেছি দেড়শ’ টাকা) রেখে দিলো। কবজি পর্যন্ত বন্দি আমার হাতেই ফিরিয়ে দিলো সেই ওয়ালেট। দুই পকেট থেকে দুই ফোন বের ক’রে নিয়ে বাসার চাবির গোছাটাও আমার পকেটে ঠিকঠাকই রেখে দিলো সেই ভালোমানুষের দল। এটুকু কাজ সেরে গলি থেকে স্কুটার ঘুরিয়ে আবার মূল রাস্তার দিকে নিয়ে আসতে আসতে, মাঝেমধ্যেই শুধু শুধু অভিনয়ে স্কুটারওয়ালাকেও গালি দিতে দিতে, চশমা খুলতে গ্যালো আমার চোখে মলম দেয়ার জন্য। আমি সেটা করতে হবে না বলার অপরাধে বাঁয়ের ছেলেটা পাশ থেকে একটা বিকট চড়ও মারলো, যাতে চশমাটা বেকে গ্যালো, চোখ থেকে বেরিয়ে নাকে ঝুলে থাকলো কোনোমতে। মায়োপিক চোখ আর ঝুলে-পড়া চশমা নিয়ে প্রায় অন্ধ অবস্থায়ই ছিলাম আমি ওদের সাথে বাকি কয়েকটা মিনিট। বড় রাস্তায় উঠেও সামনের দিকে আরো কিছুক্ষণ এগিয়ে সাতরাস্তার কিছু আগে এমনই আরেকটা অন্ধকারে স্কুটার থেকে নামিয়ে দিলো আমাকেই, যেখানে রাস্তা সবচেয়ে নির্জন আর জনসুবিধাবঞ্চিত। নামিয়ে পিছন দিয়ে ঠেলে আরো কিছুটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো- “পিছনদিকে হাঁইট্যা যা, সামনে তাকাইলেই গুলি কইরা দিমু”। মলম কিংবা গুলি খাওয়ার সব সম্ভাবনা শেষে রাস্তায় মারা গ্যালো আমার। জানরক্ষার সেই ভ্যাবাচ্যাকা সান্ত্বনা নিয়ে আমি আরো মিনিট আধেক পর উল্টো ঘুরলাম, কিচ্ছু আর নাই ততোক্ষণে সেদিকে। এগুলাম সামনের দিকে, প্রথম লক্ষ্য কোনো একটা ফোনের দোকান। সেই একই সান্ত্বনা নিয়ে তারপর আবার চলতেই থাকলাম, বোকার মতো আরো হয়তো বেঁচেও যাবো বিশ-পঁচিশ বছর! হায়!

শিল্পকলায় পৌঁছে আমার সর্বশেষ অবস্থার সবিস্তার দেয়ার জন্য বন্ধুর ফোন থেকে যখন বড়ভাইকে ধরলাম দ্বিতীয়বারের মতো, তখন তার কণ্ঠে বিস্ময়টাই বেশি- “হোয়াই ইউ অ্যাগেইন অ্যান্ড অ্যাগেইন?!” আমি জানি না এটার উত্তর। বরং এটাই জানি যে আরো মানুষেরও হয়। যখন হয় তখনই হয়, তার আগে পর্যন্তই সে বহাল নিরাপদ বা সৌভাগ্যবান।

যাক। যা যাওয়ার, গ্যাছে আবারও। “সব আল্লাহ্'র ইচ্ছা!” এখন আমি আবার চারদফা শপথ নিয়েছি ভালো হয়ে যাওয়ার। যতোটা সম্ভব এই দেশের যোগ্য নাগরিক হয়ে যাবো আবার। আপনারাও সাথে একটু আধটু হাত তুলতে আর গলা মিলাতে পারেন, লাভ ছাড়া ক্ষতি কিছু হবে না বোধ করি। আমি শপথ করিতেছি যে-

× শুধু কথা বলা আর এসএমএস করা যায়- এমন লো-কস্ট বেসিক ফোনসেট ছাড়া আর কিছু এই দেশে কখনও আর ব্যবহার করবো না।
×× সাথে নগদ টাকা কখনই খুব বেশি রাখবো না।
××× একান্ত প্রিয়জনের কোনো মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি ছাড়া, যতো তাড়াই থাক, রাতের বেলায় এই শহরে অন্তত একা কখনও সিএনজি-স্কুটার বা রিকশায় আর উঠবো না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টই পাবলিকের বন্ধু, হ্যাঁ সত্যিই।
×××× “এই দেশ” নিয়ে বা “এই দেশে আমি” নিয়ে আর স্বপ্ন(দোষ) না দেখার জন্য সদা সচেষ্ট থাকবো।

আমিন।

[৬ মে ২০০৯, দুপুর
মহাখালী, ঢাকা]

(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০০৯-০৫-০৬ ১৪:০৫)

কোন মন্তব্য নেই: