ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

মঙ্গলবার, ৩১ আগস্ট, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] "আমি কি এক নেসেসারি এভিল?!"

“আমার নামের উচ্চারণটা আদতে কঠিনই একটু। খটমটই ছিল, কিন্তু আমি এতই মুখে মুখে ফিরি আমার জন্মের পর থেকেই, যে খুব সহজ আর মাউথেবল-ই হয়ে গ্যাছে এই ‘ক্যান্সার’ শব্দটা অ্যাতোদিনে! বিজ্ঞানী আর চিকিত্সকরা আমাকে এই রেজিস্টারি নামেই ডাকেন যদিও, এই অঞ্চলে জ্ঞান-বইয়ের বাইরের আলোচনায় সমঝদার-রসিক-অনুরাগী মানুষেরা অন্য একটা নরম ডাকনামও দিয়েছেন আমার- ‘কর্কট’! আমি বাবা কর্কট-মকর বুঝি না, বুঝি না আমাকে নিয়ে মানুষ কতোটা কষ্ট পায় আর অসহায় জেদি হয়! এসব বুঝলে আমার চলবে না। আমি শুধু
জন্ম থেকে সেজন্যেই কাজ ক'রে যাচ্ছি নিঃশর্ত নিষ্ঠায় নিরন্তর, যেজন্যে আমার জন্ম।

তুমি যতোই কাছাকাছি দৃষ্টান্ত না দেখে মুক্ত কিংবা নিরাপদ মনে করো না কেন নিজেকে, কখন যে তোমার দেখা হয়ে যাবে পাশের বালিশটিতেই আততায়ী হয়ে শুয়ে থাকা আমার সাথে, তা তুমি জানো না কখনই! আমি ঠিকই কাজ ক'রে যাই গোপনে গোপনে। শরীরের সওয়ার হয়ে আমি মুচড়ে দিই হৃদয়-মন আর সকল ভালোবাসা, নিংরে নিই পুরোটা শক্তিরস, দিনের পর দিন ব্যর্থ নিরর্থ ক'রে দিই আশপাশের সবগুলো জীবনপ্রবাহের সবগুলো সুতো, সুখ-আরাম-প্রেম-আমোদের সব আয়োজন। আমি পেছন থেকে ধরি এসে ঠিকা-খুনির মতো, গড়ি ক্ষত থেকে আরো ক্ষত, হুহু ছড়িয়ে যাই উত্তাপে লাল থেকে লাল আগুনের মতো, দ্রুত থেকে দ্রুত, কোষ থেকে কোষে, পেরিয়ে যাই শরীর থেকে শরীরেও। এভাবেই আমি চড়ে বেড়াই তোমাদের শরীর থেকে মনে, অতীত থেকে হালে আর ভবিষ্যতে, সভ্যতার ইতিহাস জুড়ে, এমনকি সমাজেরও রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

আমাকে স্যার স্যার করলেও আমি কাউকে ছাড় দিই না, তাতে যে আমার কর্তব্যে অবহেলা হবে! আমার শিকার কেউ যখন হয়, তখন যতো টাকা, যতো দলবল আর যতো ধৈর্যই ঢালুক না কেন আমার পিছনে, আজ হোক কাল হোক, স্বীকার তার ক'রে নিতেই হবে আমার শ্রেষ্ঠত্ব। পিছলে বেরিয়ে গ্যাছে অ্যাতো বছরে আমার-হাতেগোনা নিতান্ত সামান্য সংখ্যা কেবল, যা কখনও সামগ্রিক পরিসংখ্যানের আলোকে কোনো উদাহরণ নয়, বরং ফ্ল্যুক বড়জোর। দাঁতে দাঁত লাগিয়ে সাধ্যের সর্বোচ্চ মাপে চেষ্টা তবু ক'রেই যায় শিকারের প্রিয়জনেরা।

মৃত্যু তো চিরন্তন। মৃত্যু তো নিয়ত নিয়ম। মৃত্যুর সেই ধ'রে নেয়া স্বাভাবিক হিসেবকেও যারা বানচাল ক'রে দ্যায় হঠাত্ হানায়, তাদের মধ্যেও আজকাল দেখি আমিই সবচেয়ে প্রতাপ-পরিক্রমশালী! তাই, আমাকেই নিশ্চয়ই তোমরা ভয় পাও যতো, ঘৃণাও করো তার থেকেও বেশি। সম্পর্কের আর পার্শ্ববর্তী মানুষের অনেক মূল্য যেই মানুষদের কাছে, ফ্ল্যুক বা মির‌্যাকল-এও বোকার মতো নাছোড় অগাধ বিশ্বাস যাদের, তাদের অ্যাতো কষ্ট-চেষ্টা আর আশার মুখে কপাট লাগিয়ে আজরাইল হয়ে যেতে আমার একেবারে যে খারাপ লাগে না, তা নয়। কিন্তু, তার জন্য তো আমি নীতি-বা-কর্তব্যবিচ্যূত হ'তে পারি না! তাতে যে আমার জন্ম-ভূমিকাই ব্যর্থ বিফল হয়ে যাবে!

আমি বরং মানুষ-সমাজে বহুকাল থাকতে থাকতে বিবর্তিত বুদ্ধিতে ভেবেচিন্ত্যে একটা ব্যাপার বের ক'রে নিয়েছি। নিজেকে ঘৃণা ক'রে তো কেউ বাঁচতে পারে না, নিজের একমাত্র ভালো অর্থ আমি তাই বের ক'রে নিয়েছি নিজের কাছেই নিজের একটা কিছু ভালো যুক্তির জন্য। সেটা হ'লো- আমি যখন কাউকে মরণ-কামড় দিই, সেই মানুষের পাশের অন্যেরা একটা বড় নাড়া খায়, ঘুমানো বা অন্যমনা মুখে ঠাণ্ডাজলের একটা ভারি ঝাপটা খায় ব'লে নড়েচড়ে উঠে সম্পর্কের সুতোটার দিকে আবার একটু দরদি চোখে তাকায়। হঠাত্ ক'রেই এই সময়টা পেয়ে তাদের মনে হয়- যে মানুষটা চ'লে যাবে ব'লে মনে হচ্ছে, সে চ'লে গেলে একটা বড় শূন্য সৃষ্টি হবে কোথাও। হ্যাঁ, একদিকে যেমন তারা প্রস্তুতি নেয় সেই শূন্যের জন্য, অন্যদিকে আবার যার যা আছে তা-ই নিয়ে তারা সম্মিলিত সংখ্যা হয়, প্রস্তুত হয় আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধে। আমার মতো অপশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়েই তাই প্রায়-ছুটে-যাওয়া সেই সম্পর্কগুলোও পেয়ে যায় নতুন কোনো গাব দেয়া সুতো। যে মানুষটা আমার দাপটের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে চোখ বন্ধ করে, ম'রে যাওয়ার আগে সে নাড়িবাঁধা অন্য বেঁচে থাকা মুখগুলোকে একটা হ্যাঁচকা টানে কাছে এনে দিয়ে যায়। সে ম'রে গিয়েই অন্যদের কাছে তার এবং সেই অন্যদেরও জীবনকে আরো বেশি অর্থপূর্ণ আর মূল্যবান ক'রে দিয়ে যায়।

যাদের আবার রক্তীয় আত্নীয়তার বাইরে এবং ঊর্ধ্বে মানুষ-মানুষের-জন্য ধরনের সংঘবদ্ধ হামদর্দি-তে আস্থা, যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনগুলো নিয়ে প্রাচীর হয়ে প্রাকার হয়ে দাঁড়িয়ে যায় জীবনের জন্য, তাদের প্রতি এমন সময়ে মাথা নুয়ে আসতে চায় আমারও! এই অবিবেচক আমারও নিজেকে ছোট লাগে তখন। আমার মতো অশুভ এক অসুখও সংকোচে তখন ছোট হয়ে যেতেও চাই আরো। এমনও মনে হয়, যেই ভালো অর্থের কথা বলছিলাম, যে- আমি ছিলাম ব'লেই তোমরা এমন টের পাও, যে ওই সঙ্গীগুলোকে তোমরা হারাতে চাও না জীবনের মহারথের পথ থেকে। আমি মারি বলেই বুঝতে পাও- ওর জীবনও তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, তাই তো নিজের প্রাত্যহিকতা ভুলে গিয়েও ছুটে আসো ওকে বাঁচিয়ে রাখবার রণে।

আজকাল মাঝেমধ্যে আমারও ইচ্ছে করে তোমাদের কাছে পরাস্ত হ'তে। আমার স্রষ্টাকে বলতে পারি না, তাকে দেখি না পাই না ব'লেই বলতে পারি না। কিন্তু আমার পাশে তোমরা যারা হাতে হাত ধ'রে কাঁধে কাঁধ রেখে হেঁটে বেড়াও আজকাল নির্ভয় খ্যাপার মতো, তাদেরকে কানে কানে বলি- আমার মাঝেমধ্যে এমনই বিশ্রী লাগছে আজকাল নিজেকে নিয়ে, যে আমার ইচ্ছে করে- আমিই ম'রে যাই, জিতে গিয়ে বেঁচে থাকুক বরং তোমাদের এই একাট্টা শক্তি আর ভালোবাসা।”

(ভূমিকার মতোই, তবু দিলাম বড়সড় শেষটীকায়:
কাছের বন্ধুরা জানে- আমার মাতুল বংশের রক্ত (/জিন) ক্যান্সারগ্রস্ত। খুব কাছের কাছের অনেক রক্তীয় আত্নীয়কে ক্যান্সারের হুকুম মেনে চোখ বুজে চ'লে যেতে দেখেছি- মুখ বুজে কেবল সহ্য করেছি হিসেবে রেখেছি সেই চ'লে যাওয়া। আর হ্যাঁ, সেটা পৌঁছে গ্যাছে আমাদের প্রজন্ম পর্যন্তও। শেষ শিকার হ'লো খালাতো বোন, যার বয়স আমার চে’ বেশি ছিলো কেবল দু’বছর! এই রোগ ছোটবেলা থেকেই ভাবনায় ভুগিয়েছে বেশ, সেই তখন থেকেও, যখন কিনা ভাবতাম - বা জানতামই বরং - যে বিড়ি-সিগ্রেটের মতো বাজে জিনিস খাওয়াই এই শাস্তিরোগের একমাত্র কারণ! আর, সেই জানায় এখন এই একত্রিশ বছরে কতো পরিপক্কতা, কতো বয়সজ্বরা, আরো কতো চিন্তাখরা!
মুক্তিযোদ্ধা খালেদ চাচার টি-সেল লিম্ফোমা’র বিরুদ্ধে সাহসী প্রত্যয়ী অভিযানটির খুব যে অংশ হ'তে পেরেছি পারছি তা যদিও নয়, বিষয়গুলো আমার অন্যথা-সংশ্লিষ্টতার কারণে হ'লেও আমাকে ভাবাচ্ছে অনেক বেশি ক'রেই, বরাবরই। তার মধ্যে আবার রণদা’র বাবারও দেহান্তরে আমি প্রকৃতির বা মনোহীন ঘটনাচক্রের যে নীতিহীন পরিহাস পেলাম আরো একবার, তার জেরে ক্যান্সার আরো একবার জোরেশোরে আমার মস্তিষ্কে। ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যাপারটা আমার ভাবনায়, ঘুরপাক খাচ্ছি আমিও তো আসোলে বেঁচে-যাওয়া-ছেঁচে-যাওয়ার একই ওই নিয়ন্ত্রণোর্ধ্ব লটারিতেই!)

(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০০৯-০৫-২৮ ১২:৩৮)

কোন মন্তব্য নেই: