ধুলো ঝেড়ে, সোঁদা ঘাসে পেতেছি মাদুর ...

সৌজন্যের অভ্যাস আর শান্তিতে বিশ্বাস থাকলে যেকোনো মহল্লার যেকোনো প্রাপ্তমনস্ক ছেলে বা মেয়েই এই মাঠে খেলতে পারবে। খেলার ডাক না দিতে পারলেও অংশগ্রহণের জন্য আসতে কারো জন্য কোনো বাধা-নিষেধ বা রেষারেষি নেই। হোক খেলা, তবু সব খেলারও তো কিছু নিয়মনীতি আছে, তাই না? স্বাধীনতার একটা যমজ ভাই আছে, নাম দায়িত্ব। সেমতে, নীতির ওপর আস্থা রাখা গেলে নিয়মের ভার নিশ্চয়ই বেশি একটা কঠিন হবে না। আর, প্রয়োজনে কখনো বল/ব্যাট/গার্ডার/গ্লভস জাতীয় জিনিসপত্তর খেলোয়াড়ের নিজের ঘর বা গাঁট থেকে নিয়ে আসতে হ'তে পারে। তবে, সুঁই-আলপিন-ছুরি-চাকু-ইট-পাথর-ডাণ্ডা বহন ভীষণভাবে নিষিদ্ধ!

সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০১০

[হিজরতপূর্ব] বিন্দু থেকে বেশিই! (খুচরোমন্থন)

আমি পনেরো মিনিট হেঁটে যেখানটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম বাসের জন্য, সেখানেই এমন একটা চোরাগুপ্তা গলি গ’লে উপস্থিত হয়েছিলে তুমি, যে গলির উপস্থিতিই আগে কোনোদিন তাকিয়ে দেখা হয়নি আমার। রিকশা থেকে নেমে গুটিপায়ে একটু উঠে তুমি দাঁড়ালে বাস-কাউন্টারের পেছনটায়, যেমন ক’রে আমিও দাঁড়াতাম ইউনিভার্সিটির বাসের জন্য, সেই পাঁচ বছর আগে শেষ ক’রে আসা জীবনে। কেন যেন নিঃসংশয় ধারণা হয়ে গ্যালো সাথে সাথেই- ভার্সিটির বাসের জন্যই তোমার ওই ছোট্ট অপেক্ষা! এখন মনে হচ্ছে- তোমার এই হঠাত্-দেখায়
মনের ভেতর একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলাম তবে, তাই এটাও তখন আমার মাথায় আসেনি একেবারেই, যে- ভার্সিটির বাসের জন্য হ’লে তোমার দাঁড়াতে হ’তো রাস্তার অন্য পাশটায়। তখনকার জন্য আমাকে বেশ অবাক ক’রেই, একটু বরং চোখ-চকচক খুশি ক’রে দিয়েই কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার একই বাসের টিকিট কাটলে তুমি! হ্যাঁ মেয়ে, আমার হতচকিত মুগ্ধ চোখ তোমার ওপর একটু রোমান্টিক ডিটেক্টিভগিরি করছিল বটে।

তোমার গায়ের রং অনুজ্জ্বল ফর্সা, প্রথম দেখায় তোমাকে অবাক আপন বা কাছের ভাবতে ভয় করেনি আমার। ভরাট কিন্তু ধারালো সৌষ্ঠবের মধ্যেই পা ঢেকেছো খাকি সালোয়ারে, আর কালো জামার ওপর আবার রেখেছো খাকি ধারওয়ালা কালো ওড়না। পুলিশের পোশাকের ওই রঙটিই কালোর সঙ্গে মিশে কারো উজ্জ্বল খাকি গায়ে এমন দারুণ সুন্দর দেখাতে পারে- তেমনটি আমার দেখা তো নয়ই, ধারণা-কল্পনায়ও ছিল না। বাসের জন্য ওইটুকু অপেক্ষার মধ্যেই উঁকিঝুঁকিতে পড়তে চাইছিলাম তোমার পৃষ্ঠার আধো আধো অক্ষরগুলো, প’ড়ে যাচ্ছিলাম সব অর্থেই, অন্যের হাতের নিচ দিয়ে- এই ওই ফাঁক দিয়ে জুম-ইনের চেষ্টায় ছিল দূরের আমার আগ্রহ-বিপর্যস্ত চোখ দু’টো। রিকশা থেকে নামছিলে সময়ই তন্ময় হয়ে মুখ যা দেখেছিলাম একটু কাছে থেকে, তখনই অবশ্য মনে গেঁথে নিয়েছিলাম তোমার গালের জ্যামিতি, নাকের অহম্ আর চোখের গভীরতা।

ভেঁপু শোনার বহু আগে থেকেই দেখা যায় আমাদের নগরের এইসব বাসের মাস্তুল! কারণ সেদিকেই অধীর চেয়ে থাকে অফিস-তাড়ায় ব্যস্ত সবার সবগুলো চোখ। যাত্রীদের কিউ তেমন ছিলও না ঠিকঠাক, তার ওপর যা-ও ছিল তা-ও ভেঙেচুরে সবাই পটাপট উঠে যায় বাসে। ভাঙা দেখেও, নিজে কিছু না ভেঙে উঠলাম আমিও। ওঠার সময় সামনে-পিছনে তোমাকে পাই না কোথাও। আরো ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে নিচে-চাওয়া চোখের আড়দৃষ্টিতে অবশ্য ঠাহর করতে পারলাম- আমরা জনগণ যখন সামনের গেট দিয়ে বাসে উঠলাম, তখন সাধারণের ঝামেলা এড়িয়ে তুমি গ্যাছো পিছনের গেট ধ’রে। যাক, উঠলে তো! আরো কিছুক্ষণের জন্য হ’লেও তুমি আমার কিছুটা হ’লেও কাছাকাছি থাকবে তো!

খুব সকালে আর খুব কোনো ছুটির দিনে ছাড়া আমাদের স্টপেজ থেকে আমাদের এই বাসে সাধারণত সিট পাওয়া যায় না। সামনে থেকে পিছনে যাচ্ছিলাম আমি, পিছনদিক থেকে সামনে আসছিলে তুমিও। কিন্তু তোমার আমার মাঝখানে স্থির দাঁড়িয়ে গ্যাছে আমার অপরিচিত একজন আম-শত্রু। সেই লোককে আমি একবার এমনিতেও বললাম আমার দিকে আরো চেপে আসতে, আমাদের পরেও যারা উঠছে ওই কাউন্টারে এবং আরো পরে, তাদেরও উঠতে পারার মতো ক’রে যেন জায়গাটার সদ্ব্যবহার হয়। সেই তাগিদ একটু পর থেকে আরো বেশি ক’রে পাচ্ছিলাম ভিতরে, যখন বুঝতে পারলাম- ওই খবিসের আড়ালে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকা তুমি মাঝখানে প’ড়ে ঠিক থাকতে পারছো না, হিমশিম খাচ্ছো সোজা দাঁড়াতে পারা নিয়েই। মনে মনে খিঁচড়ে ওই ব্যাটাকে আরো অন্তত দশবার বলেছি আমার দিকে আরেকটু চেপে তোমাকে একটু সুবিধা ক’রে দিতে। কিন্তু যে কি না মুখের কথায়ই একটুও নড়েনি, সে আর আমার অন্তর্যামী কী ক’রে হবে?

হঠাত্, আমি দেখলাম ঘোরের মধ্যে- ভারসাম্যের খাতিরে একবার ওই খবিসের হাতের নিচ দিয়েই তোমার হাত এগিয়ে এলো একটি সিটের হেলানের ওপরকার রডে, যেটায় কি না আমারও এক হাত! দেখলাম ঘোরতর ঘোরেই- গোটা গোটা পুরুষ্ট আঙুলগুলো তোমার কেমন মিষ্টি একটা পঞ্চদল ফুল তৈরি ক’রে আছে! দেখলাম- হাতে তোমার চুড়ি রয়েছে ডজন খানেক, তাতেও মেলানো আছে খাকি-কালোর একই সেই নেশা-ধরানো খেলা। আমার হাত একটু নামিয়ে আনি আমি, মূলত তোমার হাতের নিরাপদ জায়গা ক’রে দিতেই। তবু কিছুক্ষণ পরে রড পিছলে তোমার হাত এসে ঠেকলো আমার হাতে। হঠাত্ মনের মধ্যে চমকে গেলাম আরো। নরম হাতের অচেনা ছোঁয়ায় মনে মনে চিরায়ত ফাল্গুনী রচতে রচতেও, আমি তবু আরো একটু নামিয়ে আনলাম আমার হাত। কিছুক্ষণ পরে যখন আবার তোমার হাত লাগলো এসে আমার হাতে, আমার সত্যিই সরানোর আর জায়গা ছিল না নিচের দিকে। বুঝলাম কিছুক্ষণে, অবস্থা-বাধ্য এই স্পর্শ তোমাকে বিচলিত করছে না মোটেই। আমি বরং খুশিই হয়ে যাই তীব্র তীক্ষ্ন ছেলেমানুষিতে, তোমার ওই অবিচল ছোঁয়ায়। ছোঁয়ার এই পৃথিবীর কোনোকিছুতেই কিছু যাচ্ছে আসছে না আমাদের মাঝখানের যেই খবিসের, সেই খাম্বার জন্য তোমার মুখ দেখতে পাচ্ছি না আমি। ঘাড় ঘুরিয়েই তার ভাবলেশহীন বোকা মুখ পাশ কাটিয়ে একবার তবু দেখলাম আমি তোমার মুখ, লজ্জাতীত সরল উত্সাহ নিয়েই। অন্যদিকে তাকিয়ে যদিও, আড়চোখে সেই মুহূর্তে তুমিও যেন আমার চাওয়াটাই চাইছিলে ভিতরে ভিতরে। কতোই না বাঙ্ময় দেখলাম সেই চুপচাপ শান্ত মুখটিই! আমার চোখের সেই অভিভূত ভাষা তুমি একটু হ’লেও বুঝেছো নিশ্চয়ই। কথা হয় না তোমার সাথে। হওয়ার কথাও নয়।

আড়চোখের আড়দ্যাখা হ’লেও হ’লো আরেকটু পূর্ণাঙ্গ তোমাকে, যখন কি না পরের সবচেয়ে বড় স্টপেজটাতে নেমে গ্যালো অনেকেই, আর তুমি যে বসার জায়গা পাচ্ছো সে-বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে পরে আমিও বসছিলাম একটু সামনের অন্য সিট-এ। দাঁড়িয়ে টালমাটাল এতক্ষণের ধকলের পর ওড়না ঠিক করছিলে ব’সে। কেমন আত্নমগ্ন সেই চর্যা, তবু কতোটাই না দুলিয়ে দিল আরো একবার এই সুদূর আমার অভাবী মনটাকে! তার পরের স্টপেজেই নামার পালা আমার। নামলাম। তোমাকে আবার সারাজীবনের জন্য আমার থেকে সরিয়ে নিতে নিতে বাসও এগিয়ে যেতে থাকলো আবার। ফুটপাতে উঠতে উঠতে আমি তখনও দেখলাম- জানলার ধারে শান্ত বসা তোমার দৃষ্টি আমার দিকে না হ’লেও আমার দৃষ্টির দিকে অবশ্যই। নিজে না তাকিয়েও ঠিকই তুমি দেখছিলে আমি তাকাই কি না শেষবারটি, চাইছিলে আমি তাকাই।

মুগ্ধতাই দেখছিলে তুমি, মুগ্ধ হয়ে নয় নিশ্চয়ই। আমি তাকিয়েছিলাম কি না, তাতে তোমার তাই কিচ্ছুটি যায় আসে না জানি। আমারও বহুকাল এমন পাসিং-বাই-গন নারীগণের ব্যাপারে কিছুই যায় আসে না। বহুদিন পরেই আজ আবার নিজেই অবাক হ’লাম নিজের এই নির্বাক মুগ্ধতায়। কোন্ বাড়িতে থাকো তুমি- জানি না। তাতে কিচ্ছু যায় আসে না আমার। কেন না এই জীবনে আর কোনোদিন হয়তো সত্যিই দেখাই হবে না তোমার সঙ্গে। কার কাছে বা কোথায় যাচ্ছিলে- এসবেও কিচ্ছু যায় আসে না। কী করো তুমি, তোমার বয়স-ই বা কতো- তাতেই বা কী যায় আসে! তবে, এতক্ষণে বলা হয়নি হে অচেনা সুন্দর- আমার তবু অনেক কিছুই যায় আসে তোমার উজ্জ্বল খাকি নাকের ওই ছোট্ট কালো নাকফুলটায়!

[২৯ ডিসেম্বর ২০০৮, অন্যপুর]
(আদি পোস্টাইম @সচলায়তন: ২০০৮-১২-৩০ ১৮:৫৬)

কোন মন্তব্য নেই: